নাদিয়া বলল, প্রণব কাকার কাছে শুনেছি তুমি সুন্দর গান করতে। একটা গান কি আমাকে শোনাবে?
পদ্ম স্পষ্ট গলায় বলল, না।
মানুষ যখন কাদে তখন চোখের জলের সঙ্গে কষ্ট বের হয়ে আসে। আবার যখন মানুষ গান গায়, তখন সুরের সঙ্গে কিছু কষ্ট বের হয়। লক্ষ্মী পদ্ম, আমাকে একটা গান শোনাও। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখো! এমন সুন্দর জোছনায় বনে যেতে ইচ্ছা করে। আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। এই গানটা কি জানো?
পদ্ম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
গাইবে।
পদ্ম না-সূচক মাথা নাড়ল।
আকাশের চাঁদ তার আলো ফেলে যেতে থাকল। মানুষের আবেগের সঙ্গে এই আলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
হাজেরা বিবির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে
হাজেরা বিবির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে, তবে গলার স্বর এখনো টনটনা। তিনি জানিয়েছেন ঘরে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুতে তার মত নেই। তাকে মরতে হবে ঘরের বাইরে। ঘরে মারা গেলে আজরাইল ঘর চিনে ফেলবে, তখন আরও মৃত্যু হবে। তিনি একঘেয়ে গলায় সুর করে বলতে লাগলেন, দিঘির ঘাটে মরব। দিঘির ঘাটে মরব।
তাঁকে ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে খাট পাতা হয়েছে। তার মাথায় ছাতা ধরা হয়েছিল। হাজেরা বিবি বলেছেন, কালো ছাতা মাথায় ধরা যাবে না। কালো রঙ আজরাইলের পছন্দ। ছাতা দেখে দৌড়ে আসবে।
ডাক্তার, কবিরাজ এবং হোমিওপ্যাথ—তিন ধরনের চিকিৎসকই উপস্থিত। তাদের জন্যে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তারা শামিয়ানার নিচে বসে আছেন। তাদের জন্যে চা এবং ডাবের পানির ব্যবস্থা আছে।
মাদ্রাসা থেকে পঞ্চাশজন তালেবুল এলেম এসেছে। তারা কোরান খতম দিচ্ছে। শম্ভুগঞ্জের পীর সাহেবকে আনতে লোক গেছে। এক বস্তা তেঁতুল বিচি আনা হয়েছে। তেঁতুল বিচি গুনা হচ্ছে। এক লক্ষ পঁচিশ হাজারবার দরুদে শেফা পাঠ করা হবে। তেঁতুল বিচি গণনাকার্যে ব্যবহার করা হবে।
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন এসেছেন। তিনি হাবীবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকবে এরকম মনে হয় না। তিনি রোগীকে স্যালাইন দিতে চেয়েছিলেন। হাজেরা বিবি বলেছেন, মানুষের পেসাবের মতো এই জিনিস আমি শরীরে ঢুকাব না।
হাবীব তার মাকে বললেন, মা, কিছু খেতে মনে চায়?
হাজেরা বিবি বললেন, মর্দ হাতির একটা বিচি ভাইজ্যা আইন্যা দে। খায়া দেখি জিনিস কেমুন।
হাবীব বললেন, তুমি তো জীবনটা ঠাট্টা ফাজলামি আর ইয়ার্কিতে কাটায়া দিলে। এখন সময় শেষ; সাধারণভাবে কথা বলো। কিছু খেতে চাও?
হাজেরা বিবি বললেন, তোর বাপের অতি পছন্দের খানা ছিল সজনা দিয়ে খইলসা মাছের ঝোল। উনার মৃত্যুর পর এই জিনিস আমি আর কোনোদিনই খাই নাই। আজ যখন চইলা যাইতেছি, খইলসা মাছ খাইতে পারি।
সজনা এবং খইলসা মাছের সন্ধানে চারদিকে লোক গেল।
জন্মের যেমন আয়োজন আছে মৃত্যুরও আছে। প্রণব ব্যস্ত হয়ে সেই আয়োজন করছে। সারা দিন বাড়িতে প্রচুর লোক আসবে। তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী সাত দিন এই বাড়িতে চুলা জ্বলবে না। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে তোলা খাবার আসবে। সবাই খাবার দিতে চাইবে। সবার খাবার নেওয়া যাবে না। যাদের খাবার গ্রহণ করা যাবে, তাদের একটা লিস্টি করতে হবে। কে সকালে পাঠাবে, কে বিকালে, কে রাতে সব লেখা থাকতে হবে।
মৃত্যুর খবর সব আত্মীয়কে অতি দ্রুত জানাতে হবে। লোক মারফত এবং টেলিগ্রামে। কেউ যেন বলতে না পারে আমরা খবর পাই নাই। খবর না পাওয়া নিয়ে বেশিরভাগ সময় বিরাট পারিবারিক কোন্দল হয়।
আজ দুপুরে শ’খানেক মানুষ খাবে। তাদের আয়োজন করতে হবে। মাছ করা যাবে না। মৃত বাড়িতে মাছ নিষিদ্ধ। প্রণব একটা গরু এবং একটি খাসি জবেহ করার ব্যবস্থা নিলেন।
জামে মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন হাজেরা বিবিকে তওবা করাতে। হাজেরা। বিবি বললেন, আমি তওবার মধ্যে নাই। ইমাম সাহেব বললেন, তওবা কেন করবেন না আম্মা? আমরা সবাই জানা অজানায় কত পাপ করি!
হাজেরা বিবি বললেন, আমার সামনে কেউ অপরাধ করলে আমি তার শাস্তি দেই। কোনোদিন ক্ষমা দেই না। আমি নিজে কেন আমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা নিব? অপরাধ যা করেছি তার শাস্তি মাথা পেতে নিব। ক্ষমা নিব না। তবা করতে হয় আপনি আপনার নিজের জন্যে করেন। আমি বাদ।
হাজেরা বিবি নাদিয়াকে তার পাশে বসিয়ে রেখেছেন। নাদিয়াকে বলেছেন, আমার চোখের মণির দিকে তাকায়া থাক। মৃত্যুর সময় চোখের মণির ভেতর থাইকা গোলাপি আলো বাইর হয়। আমি দুইবার দেখছি। মজা পাইছি! তুই দেখ মজা পাবি।
নাদিয়া দাদির চোখের মণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাইলী এসে বললেন, আম্মা! আপনি একটু আল্লাখোদার নাম নেন।
হাজেরা বিবি বললেন, খামাখা উনারে বিরক্ত কইরা কোনো লাভ আছে? তোমার ডাকতে ইচ্ছা হয় তুমি ডাকো।
এর পরপরই হাজেরা বিবি ঘোরের মধ্যে চলে যান। তাঁর জবান বন্ধ হয়ে যায়।
হাজেরা বিবির খবর পেয়ে হাবীবের জুনিয়র উকিল আব্দুল খালেক এসেছেন। চেম্বারে চিন্তিতমুখে বসে আছেন। তাকে চা দেওয়া হয়েছে, তিনি চা খাচ্ছেন না। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিলে তিনি যে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন তা প্রকাশ পায় না।
হাবীব চেম্বারে ঢুকতেই আব্দুল খালেক উঠে দাঁড়ালেন এবং ভাঙা গলায় বললেন, কী সর্বনাশ হয়ে গেল।
হাবীব স্বাভাবিক গলায় বললেন, সর্বনাশ এখনো হয় নাই। তবে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তুমি এসেছ ভালো হয়েছে, ফরিদের মামলাটা নিয়ে আলাপ করি।