যে-কোনো সমস্যায় প্রণব বাবুকে বলবা।
জি আচ্ছা।
প্রণবকে আমার কাছে পাঠাও।
সফুরা উঠে দাঁড়াল। হাবীবকে কদমবুসি করে ঘর থেকে বের হলো। আশ্চর্যের কথা, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সেও দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল। প্রণব কাছেই ছিল, ছুটে এসে সফুরাকে টেনে তুলল। বিরক্ত গলায় বলল, তুমি ভরা মাসের পোয়াতি। সাবধানে চলাফেরা কর না? ব্যথা পেয়েছ?
জি-না।
যাও ঘরে গিয়া শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করবা না।
প্রণব এসে হাবীরের সামনে রাখা চেয়ারে বসল। হাবীব বললেন, নাদিয়াকে একটা খবর দাও তো। সে আছে কোথায়?
দিঘির ঘাটে বসেছে।
এত রাতে দিঘির ঘাটে কী?
জোছনা দেখে। ভয়ের কিছু নাই। পাহারাদার রেখে দিয়েছি। ভাদু আড়ালে বসে পাহারা দিতেছে। নাদিয়া আম্মার সাথে হোসনা মেয়েটাও আছে। আপনাকে একটা খবর দিতে ভুলে গেছি।
এখন দাও।
আপনি রোকেয়া হলের দু’টা মেয়ের ব্যাপারে সন্ধান নিতে বলেছেন। সন্ধান নিয়েছি। আগেই সন্ধান পেয়েছিলাম। বলতে ভুলে গেছি। আজকাল কিছু মনে থাকে না। বানপ্রস্থের সময় হয়ে গেছে।
হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, ফালতু কথা না বলে মূল কথা বলো। সন্ধানে কী পেয়েছ?
তিনশ’ এগারো নম্বরে যে মেয়ে দুটা থাকে তাদের একজনের নাম বকুল বালা। সে কেমিস্ট্রির ছাত্রী। অন্যজনের নাম শেফালী, তার সাবজেক্ট পলিটিক্যাল সায়েন্স। শেফালী মেয়েটার বিবাহ ঠিক হয়েছে। ছেলে ডাক্তার। এই দুই মেয়ের বাড়ির ঠিকানাও নিয়ে এসেছি। ঠিকানা বলব স্যার?
না। আর কিছু লাগবে না।
হাবীব দিঘির ঘাটের দিকে রওনা হলেন। নাদিয়াকে দেখা যাচ্ছে। কেমন হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে। নাদিয়ার সামনে হোসনী। তার শরীর যথারীতি চাদর দিয়ে ঢাকা। সে মাথা নিচু করে আছে।
ঘাটের সিঁড়ির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভাদু। ভাদু তাকিয়ে আছে। নাদিয়ার পায়ের দিকে। শাড়ি সামান্য উঠে থাকার কারণে ডান পাটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। তার ভাগ্য ভালো হলে পা নড়াচড়ার সময় শাড়ি হয়তো আরও উপরে উঠবে। ভাদুর কাছে মেয়েছেলের আসল সৌন্দর্য পায়ে। এই মেয়ের পা সুন্দর আছে। ভাদু চোখ বন্ধ করল। নিজেকে সামলানোর জন্যে কাজটা করল। ইশ এমন যদি হতো মেয়েটা একা। আশেপাশে কেউ নেই। আচমকা তার মুখ চেপে ধরলে সে শব্দ করতে পারবে না। মুখ চেপে কার্য সমাধা করে কিছুক্ষণ গলা চেপে ধরে থাকা, তারপর পালিয়ে যাওয়া। ভাদু ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।
হাবীব মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমল গলায় ডাকলেন, নাদিয়া।
জি বাবা!
অন্ধকারে বসে আছিস কেন?
নাদিয়া বলল, অন্ধকার কোথায়! চাঁদের আলো আছে।
হাবীব মেয়ের পাশে বসে মনে মনে একটি অতি জরুরি চিঠির মুসাবিদা করা শুরু করলেন। চিঠিটা লেখা হবে হাসন রাজা চৌধুরীর বাবা রহমত রাজা চৌধুরীকে।
রহমত রাজা চৌধুরী
জনাব,
আসসালাম! একটি জরুরি বিষয় জানাইবার জন্যে আমি আপনাকে পত্র দিতেছি। নানান কারণে আপনার পুত্রকে আমার পছন্দ। আমার একমাত্র কন্যা নাদিয়ার সঙ্গে কি তার বিবাহ হইতে পারে? আমি অধিক কথা বলিতে পছন্দ করি না। এই কারণে এক লাইনে মূল কথা বলিলাম।
ইতি
হাবীব খান।
পুনশ্চ : জানুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে আমার সর্ববৃহৎ আকারের একশ’ পাবদা মাছের প্রয়োজন। ডিসট্রিক্ট জজ আবুল কাশেম সাহেবের কন্যার বিবাহে এই মাছ প্রয়োজন।
এই চিঠি এখনই পাঠানোর প্রয়োজন নাই। আগে মামলার রায় হোক। তারপর। নিশ্চিন্ত মনে আগাতে হবে। মামলা চলতে থাকা মানে অস্বস্তি নিয়ে বাস করা। আজ বাটকু হারুন অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষিতিশাকে ভুলা দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। বই লেনদেনের রেকর্ড কোনো কাজের রেকর্ড না। তারপরেও রেকর্ড বই নষ্ট করে ফেলা দরকার। অতি দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে।
হাবীব বললেন, মা যাই।
নাদিয়া বলল, যাও।
হোসনা মেয়েটার জবান ফুটেছে? নাকি এখনো চুপ?
এখনো চুপ, কোনো কথা বলে না বাবা।
কথা না বলাই ভালো। জগতে বড় অনিষ্ট অধিক কথার কারণে হয়।
হাবীব চলে গেলেন। ভাদু জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটু কাছে এগিয়ে এল। এত দূর থেকে ভালোমতো দেখা যায় না। সে খানিকটা চিন্তিত নতুন মেয়েটা সবসময় নাদিয়ার সঙ্গে আছে। দুইজনকে একসঙ্গে কায়দা করা যাবে না। দুইজনের একজন চিৎকার করবেই।
দিঘির ঘাটে হোসনা এবং নাদিয়া বসে আছে। তাদের গায়ে চাদের আলো পড়েছে। দিঘির এক কোনায় অনেকগুলি শাপলা ফুল ফুটেছে। এই ফুলগুলি বড় বড়। চাঁদের আলোয় ফুলের প্রতিবিম্ব পড়েছে পানিতে। বাতাসে ফুল কাঁপছে, প্রতিবিম্বও কাপছে। নাদিয়া আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই জায়গায় আমি একবার ভূত দেখেছিলাম।
হোসনা আঙুল লক্ষ করে তাকাল। আর কোনো ভাবান্তর হলো না।
নাদিয়া বলল, মাঝেমাঝে তুমি কেঁপে ওঠো। এর কারণ কী বলো তো।
হোসনা জবাব দিল না।
নাদিয়া বলল, তোমার ঘটনা আমি শুনেছি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে। তোমার মতোই আমি কষ্ট পাচ্ছি। যতবার তোমাকে দেখি ততবার কষ্ট পাই। আমি তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। সাইকিয়াস্ট্রিস্ট দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাব। I Promise.
নাদিয়া বলল, তুমি একটু কাছে আসো। আমি তোমার পিঠে হাত রেখে কথা বলি।
হোসনা নড়ল না। যেখানে বসে ছিল, সেখানেই বসে রইল। নাদিয়া বলল, তোমার হোসনা নামটা আমার পছন্দ না। আমি তোমার একটা নতুন নাম দিলাম, পদ্ম! এই নামটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
পদ্ম হঁ-সূচক মাথা নাড়ল।