জজ সাহেব বললেন, আপনার কথায় যুক্তি আছে। করুন ব্যবস্থা। ভালো কথা, গভর্নর সাহেবের দাওয়াতের চিঠি কি আপনার কাছে দিব?
হাবীব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমার কাছে দেবেন। এই শুক্রবারে ঢাকায় যাচ্ছি। চিঠি হাতে হাতে পৌঁছে দিব।
মাগরেবের নামাজ শেষ হয়েছে। হাজেরা বিবি নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। এখন সেজদার জন্যে মাথা নিচু করলে সেই মাথা খাড়া করতে কষ্ট হয়। আমেনা বলে এক তরুণীকে রাখা হয়েছে, সে হাজেরা বিবির হয়ে নামাজ পড়ে। নিজের জন্যে পড়ে না। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে ফতোয় আনা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় এটা সম্ভব। বদলি-হজের মতো বদলি-নামাজ। বদলি-হজ যে করে সে হজের সোয়াব পায় না, যার জন্যে হজ করা হয় তিনি সোয়াব পান। বদলি-নামাজেও একই ব্যাপার। নামাজি সোয়াব পায় না, যার জন্যে নামাজ পড়া হচ্ছে তিনি সোয়াব পান।
আমেনাকে বলা হয়েছে তাকে বদলি-হজে পাঠানো হবে। হাজেরা বিবির হয়ে বদলি-হজ করে আসবে। আমেনা অতি আনন্দে আছে। সে অন্দরমহলেও বোরকা পরে। চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তাকে সময়ে অসময়ে নামাজ পড়তে দেখা যায়। যখন নামাজ পড়ে না, তখন তার হাতে লম্বা তসবি ঘুরে। এই তসবি দুই হাতে ধরে রাখতে হয়। সে দাসীমহলে কিছু গল্প চালুর চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি গল্প জ্বিন নিয়ে। তার বাবার একটা পালা জ্বিন ছিল। জ্বিনটা তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল ছিল। জ্বিনের কাণ্ডকারখানায় বিরক্ত হয়ে আমেনার বাবা জ্বিনকে আজাদ করে দেন। তবে সেই জিন এখনো আশা ছাড়ে নাই। এখনো বছরে একবার শীতের সময় আসে। আমেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
লাইলী তাঁর নতুন দাসীকে তার শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। নতুন কেউ বাড়িতে দাখিল হওয়ার পর তিনি প্রথম পনেরো দিন তাকে দেখেন। তারপর একদিন ডেকে পাঠান। সেইদিন ঠিক হয় নতুন দাসী চাকরি করতে পারবে নাকি তাকে চলে যেতে হবে।
আমেনা ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলে ঘরে ঢুকল। তার হাতে যথারীতি লম্বা তসবি।
লাইলী বললেন, এক জ্বিন তোমার প্রেমে দেওয়ানা হয়েছে বলে শুনতে পাই। ঘটনা কি সত্য?
জি আম্মা।
সে একাই দেওয়ানা হয়েছে, না-কি তুমিও দেওয়ানা?
সে একাই দেওয়ানা। আমি কোন দুঃখে জ্বিন বিবাহ করব! জ্বিন-মানুষের বিয়ায় সন্তানাদি হয় না।
লাইলী বললেন, বিয়ে হলে সন্তান হবে না কেন? সন্তান অর্ধেক হবে মানুষ, অর্ধেক জ্বিন।
আমেনা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। এই মহিলাকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অতিরিক্ত শান্ত চোখমুখ। ঠোটে হাসির আভাস। কিন্তু কথা বলার সময় মহিলার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। কপালে ভাঁজ পড়ে।
লাইলী বললেন, এত বড় তসবি কি জ্বিন তোমারে এনে দিয়েছে?
জি। আপনি ঠিক ধরেছেন আম্মা।
লাইলী শান্তগলায় বললেন, ফাইজলামি গল্প আমার সাথে করবা না। এই মালা জন্মাষ্টমির মেলায় কিনতে পাওয়া যায়। সাধু সন্নাসীরা এই রুদ্রাক্ষের মালা গলায় পেচায়া রাখেন। এখন বুঝেছ?
আমেনা চুপ করে রইল।
সারা দিন নামাজ কালাম পড়ো, তসবি টানো, ঘটনা কী?
জ্বিনের যন্ত্রণায় এই কাজ করতে হয়। দোয়া কালামের উপরে থাকতে হয়।
লাইলী বললেন, ঘটনা তা-না। তুমি কাজকর্মের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই ভাব ধরেছ। আজ তার শেষ। তুমি নামাজের সময় নামাজ পড়বা। অন্য সময় কাজকর্ম করবা। বোরকা খোলো।
আমেনা বোরকা খুলল। লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি সুন্দরী মেয়ে। গরিবের ঘরে রূপ নিয়া আসছ। মানুষের কাছ থেকে সাবধান থাকবা। জিনের হাত থেকে সাবধান থাকার প্রয়োজন নাই। নাদিয়ার বাবার সামনে কখনো পড়বা না। তুমি অন্দরমহলের দাসী। অন্দরমহলে থাকবা।
জি আম্মা।
এখন সামনে থেকে বিদায় হও। রুদ্রাক্ষের এই মালা যেন আর কোনোদিন দেখি 1 মাল আমার খাটে রাখে।
আমেনা খাটে মালা রেখে দৌড়ে বের হতে গিয়ে চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। অন্য দাসীরা ছুটে এসে ধরাধরি করে তাকে কুয়াতলায় নিয়ে গেল। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেওয়ার পর সে চোখ মেলে অস্পষ্ট গলায় বলল, জ্বিন থাপ্পড় মারছে।
লাইলী নিজের মনেই বললেন, এই মেয়েকে রাখা যাবে না। সে অনেক যন্ত্রণা করবে। আজ যন্ত্রণার শুরু।
হাবীব বসেছেন চেম্বারে। তার সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছে সফুরা। সফুরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাবীব বলল, ভালো আছ?
সফুরা হা-সূচক মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না।
হাবীব বললেন, হারুন উকিলকে ক্ষিতিশ বাবুর কথা তুমি বলেছ?
সফুরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার হা-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বললেন, একটা কথা আছে–নারীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। এটা মনে রাখবা। শাপা অরণে আসে না। বুঝেছ?
জি।
কে না-কি ভোষর হাত দেখে বলেছে তোমার স্বামীর ফাঁসি হবে। ঘটনা কি সতা?
জি।
ভালো গণকের সন্ধান পেয়েছ। স্ত্রীর হাত দেখে স্বামীর ভাগ্য বলে দেয়। সহজ কাজ না, কঠিন কাজ। গণকের নাম কী?
সফুরা স্পষ্ট গলায় বলল, নাদিয়া আম্মা হাত দেখে বলেছেন।
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাবীব বললেন, নাদিয়া হাত দেখাও শিখেছে। ভালো তো। তারে বলব সে যেন আমার হাত দেখে তার মার ভাগ্য বলে দেয়। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি সামনে থেকে যাও। কথা যা বলেছি মনে রাখবা। তোমার স্বামীর মামলা মোকদ্দমার বিষয় আমি দেখছি। তোমার পরামর্শের প্রয়োজন নাই।
জি আচ্ছা।
সন্তান কবে নাগাদ হবে?
জানুয়ারি মাসে।