হারুন বলল, আদালতের কাছে আমি ক্ষিতিশ বাবুকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করার অনুমতি প্রার্থনা করছি। জজ সাহেব হ্যা-সূচক মাথা নাড়লেন।
হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। হারুন বিপদজনক দিকে যাচ্ছে। ক্ষিতিশ বাবু, লাইব্রেরি—এইসব তথ্য হারুন ডিটেকটিভের মতো বের করেছে তা হয় না। উকিলরা সিনেমা উপন্যাসে ডিটেকটিভ হয়। বাস্তবে পান সিগারেট খেয়ে অবসর কাটায়। হারুনকে কেউ একজন তথ্য দিয়েছে। সেই কেউ একজনটা কি ফরিদের স্ত্রী সফুরা? হারুন যখন ক্ষিতিশ বাবু সম্পর্কে কথা বলছিল তখন তাকিয়ে ছিল সফুরার দিকে।
হাবীব কাঠগড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। আয়োজন করে হাই তুললেন। এর অর্থ এতক্ষণ যে আলোচনা হলো তা হাই তোলার মতো গুরুত্বহীন। ডাক্তার এবং উকিল এই দুই শ্রেণীর মানুষদের নিজ নিজ বিদ্যার পাশাপাশি অভিনয়ও জানতে হয়। হাবীব জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউর অনার। ডুবন্ত মানুষ খড়খুটা আঁকড়ে ধরে। আসামি ফরিদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতকেও বলেছে। আমি তার পক্ষের আইনজীবী। এমন সব তথ্য তার বিষয়ে এখন উপস্থিত হচ্ছে যা আমি নিজে জানি না। ক্ষিতিশ বাবু ভুল করেছেন। সমিল চেহারার মানুষ থাকে। বলা হয় একই চেহারার মানুষ সাতজন করে তাকে। এদের একটা নাম আছে। পুরুষ হলে এদের বলে সন্তু ভ্রাতা। মেয়ে হলে সপ্ত ভগ্নি। আমি চাই ক্ষিতিশ বাবু আদালতে উপস্থিত হয় বলুক এই সেই আসামি যে নিয়মিত বই আনা নেওয়া করে।
হাবীবের বক্তৃতার পর পর আদালত মুলতবি হয়ে গেল। হাবীব এসে বসলেন প্রণবের পাশে। প্রণব বললেন, স্যার আপনার কোনো তুলনা হয় না।
হাবীব ললেন, কোনো মানুষেরই তুলনা হয় না। সারা পৃথিবীতে আমি হাবীব একজনই, আবার তুমি প্রণবও একজন। বুঝেছ?
হুঁ।
পত্রিকাটা নামাও। সারাক্ষণ মুখের উপর পত্রিকা ধরা।
বললাম না গরম খবর আছে। পড়বেন?
না।
আমি সফুরাকে বলেছি আজ সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
কখন বললা?
এক ফাঁকে বলেছি। সে খুব চিন্তিত। তার হাত দেখে কে যেন বলেছে তার স্বামীর ফাঁসি হবে।
হাবীব বললেন, একটা পান দাও।
প্রণব পানের কৌটা বের করুলেন। কোর্টরুম খালি হয়ে গেছে। হাবীব এবং প্রণব এগুলো বসে আছেন। হাবীব অস্থির বোধ করছেন। অস্থিরতার কারণ ধরতে পারছেন না। প্রণব বলব, জজ সাহেবের মেয়ের বিয়ের কথা মনে আছে, স্যার?
মনে আছে। উনার মেয়ের নাম কী?
শায়েরা বানু। উনি বিরাট আয়োজন করেছেন। আজই ঢাকা থেকে বাবুর্চি আসবে মিষ্টির কারিগরও আসবে।
বিয়ের তারিখ যেন কী?
জানুয়ারির ২০ তারিখ।
হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। জজ সাহেব খাস কামরায় আছেন। তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হওয়া দরকার।
ডিসট্রিক জজ আবুল কাশেম ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। হাবীবকে দেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, চেয়ারটা কাছে এনে বসুন। কোমরের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। বেশিক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকতে পারি না।
আমার পরিচিত এক কবিরাজ আছে। সে গাছগাছড়া দিয়ে মালিশ করার তেল তৈরি করে। অনেকেই উপকার পেয়েছে। আপনাকে তৈরি করে দিতে বলব?
বলুন। আমার মেয়ে রাতে ইন্ডিয়ান বাম ঘষে দেয়, লাভ কিছু হয় না।
হাবীব বসতে বসতে বললেন, আপনার কোন মেয়ে, যার বিয়ের আলাপ হচ্ছে সে? শাহেদা বানু?
হুঁ।
মেয়ে চলে গেলে আপনার তো খুব কষ্ট হবে।
তা তো হবেই। এই মেয়ে বাপঅন্ত প্রাণ। রোজ দুপুরে টেলিফোন করে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছি কি না। টিফিন কেরিয়ারে নিজে খাবার ভরে দেয়।
হাবীব বললেন, এই কয়দিন কোর্টে খাওয়াদাওয়া না করে বাসায় মেয়ের সঙ্গে যান।
কথাটা মন্দ বলেন নাই। বিয়েতে খাবারের আয়োজন কী করেছেন, একটু কি বলবেন?
অবশ্যই বলব। সবই আমার স্ত্রী ঠিক করেছেন। প্রথম মেয়ের বিয়ে, ধুমধাম করতে চায়।
উনি একা তো ধুমধাম করবেন না। আমরা সবাই মিলে করব।
জজ সাহেব আগ্রহ উত্তেজনায় উঠে বসলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, পোলাও, মুরগির কোরমা, খাসির কান মাংস, দই মিষ্টি, পিঠা, পান-সুপারি।
গরু রাখবো না?
হিন্দু অতিথিদের কথা বিবেচনা করে গরু বাদ দিয়েছি।
হাবীব বললেন, হিন্দু-মুসলমান এক টেবিলে খাবে না। ওরা মুরগি দিয়ে খাবে। মুসলমান মেয়ের বিয়েতে গরু না থাকলে চলে? গোমাংস ছাড়া বাকি সব মাংসই নিরামিষের পর্যায়ে পড়ে।
দেখি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি।
আপনার মেয়ের বিয়েতে আমার একজন অতিথি নিয়ে আসার বাসনা আছে। উনি আবার গোমাংস পছন্দ করেন।
জজ সাহেব বললেন, অতিথি কে?
গভর্নর সাহেব। মোনায়েম খান। উনি সামাজিক উৎসবে যেতে পছন্দ করেন। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। অবশ্যি আপনি যদি অনুমতি দেন।
জজ সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, অবশ্যই উনাকে বলবেন। এটা হবে আমার মেয়ের জন্যে বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। আমি তো চিন্তাই করতে পারি না আমার মেয়ের বিয়েতে স্বয়ং গভর্নর উপস্থিত।
হাবীব বললেন, বরযাত্রী এবং বিশিষ্ট অতিথিদের জন্যে আমি একটা আইটেম আপনাকে করে দিতে চাই। মাছের আইটেম। পাবদা মাছ। একেকটা বোয়ালের মতো সাইজ। মাছটা মাখনের মতো। মুখে নিলে মুখের মধ্যেই গলে যায়। আমাদের গভর্নর সাহেবের পছন্দের মাছ।
পাবদা মাছের ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন। খরচ যা লাগে আমি দিব।
তাহলে তো স্যার হবে না। শাহেদা বানু মায়ের জন্যে আমি কিছু করব না? আর যে পাবদা মাছের কথা বলেছি টাকা দিলে সেটা পাওয়া যায় না। ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি ব্যবস্থা করে আপনার কাছ থেকে টাকা নিব? স্যার বলুন আমি কি মাছের ব্যবসা করি।