কোর্টের অবস্থা গ্রামের হাটের মতো। লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে পান চিবুচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে উঁকি মেরে দেখছে কোর্টরুমে কী ঘটছে।
টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে বারান্দায় মারামারি বেধে গেল। হুটাপুটি শব্দ। গালাগালি। শুরুটা দুজনের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিন-চারজন যুক্ত হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ চিৎকারে কেউ একজন বলল, মাইরালছে রে। আমারে মাইরালছে। এর মধ্যেই কোর্টে বিচারকার্য শুরু হলো।
আসামি ফরিদ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। হাবীব লক্ষ করলেন, সে বেশ রোগা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। সে তাকিয়ে আছে সফুরার দিকে। অবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখছে। একবার হাবীবের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে সালামের ভঙ্গি করল। কাজটা ভুল। কোর্টরুমে তিনি ফরিদের পরিচিত কেউ না।
হাবীব তার পাশে বসা প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, খবরের কাগজ পড়া এখন বন্ধ রাখে।
প্রণব বললেন, গরম খবর আছে।
যত গরম খবরই থাকুক কাগজ বন্ধ।
প্রণব কাগজ বন্ধ করলেন। হাবীব নিচুগলায় বললেন, ফরিদের স্ত্রী সফুরা এখন ধীকে কই?
আমাদের কাছে থাকে।
তারে কখনো দেখি না কেন?
নিজের মনে থাকে। পোয়াতি মেয়েছেলেরা পুরুষের সামনে আসতে লজ্জা পায়।
তারে বলবা যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। এখন বলব?
না, সে বাড়িতে যাক তারপর বলবা। কোনো কাজে হুটহাট আমার পছন্দ।
প্রণব কানেকানে বললেন, স্যার লক্ষ করেছেন মেয়েটা এখন কেমন সুন্দর হয়েছে। শাস্ত্রে বলে স্বামী যদি দীর্ঘদিনের জন্যে পরবাসে যায় তাহলে পরবাস যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর চেহারা পূর্ণশশীর মতো হয়।
হাবীব বললেন, এখন চুপ করো।
পাবলিক প্রসিকিউটর জেরা করার জন্য এগিয়ে আসছে। হাবীব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের নাম হারুন। বয়স অল্প, কিন্তু কথার মারপ্যাঁচ ভালো শিখেছে। অতি বুদ্ধিমান। লম্বায় খাটো। কোর্টে তার নামে প্রচলিত ছড়া হলো —
বাইট্যা হারুন
চাইট্যা খায়।
হাবীব বললেন, হারুন কি বিবাহিত?
প্রণব বললেন, বাঁটকুটারে বিয়ে করবে কে? স্যার কি জানেন, ইবলিশ শয়তান বাঁটি ছিল?
না।
আমি বইয়ে পড়েছি, এইজন্যেই কথায় আছে, বাঁটি শয়তানের লাঠি।
এখন চুপ থাকো। বাঁটুটা সওয়ালজবাব কী করে শুনি।
হাবীবের সিগারেটের তৃষ্ণা হয়েছে। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট স্পর্শ করলেন। তাঁর মনে হলো, কোর্টরুমে সিনিয়র আইনজীবীদের এবং জজ সাহেবের সিগারেট খাওয়ার অনুমতি থাকলে ভালো হতো। প্রায় সময়ই জটিল মামলায় চিন্তার গিট্টু লাগে। সিগারেটের ধোঁয়া সেই গিট্টু খুলতে পারে।
আপনার নাম ফরিদ?
জি।
আপনি ভালো আছেন?
জি।
মুখে বলছেন ভালো আছেন। আপনি তো ভালো নাই। আপনার চোখ লাল। চোখের নিচে কালি। রাতে তো আপনার ঘুম হয় না।
হাবীবের ইশারায় তার জুনিয়র আব্দুল খালেক বললেন, অবান্তর প্রশ্ন। অবজেকশন ইউর অনার।
হারুন বলল, অবজেকশন যখন উঠেছে তখন এই বিষয়ে কথা বলব না। আমি স্বাভাবিক সৌজন্যে প্রশ্ন করেছি।
মূল প্রশ্নে যান। আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছ?—এইসব বাদ থাক।
কোর্টরুমে হাসির শব্দ উঠল অনেকেই হাসছে, তাদের সঙ্গে হারুনও হাসছে। হঠাৎ সে হাসি থামিয়ে বলল, ফরিদ সাহেব, আপনি গল্প-উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন, তাই না?
জি।
আমি খোঁজ নিয়েছি জেলখানার লাইব্রেরি থেকে আপনি প্রায়ই বই নিয়ে পড়েন। গতকাল রাতে কি কোনো বই পড়েছেন?
আব্দুল খালেক বললেন, অবজেকশন ইউর অনার। অবান্তর প্রশ্ন। জজ সাহেব কিছু বললেন না। তাকে খানিকটা কৌতূহলী মনে হলো ফরিদ বলল, রবি ঠাকুরের লেখা একটা বই পড়েছি স্যার নাম নৌকাডুবি’।
কবিতার বই?
জি-না স্যার। উপন্যাস। ঘটনাটা বলব?
ঘটনা বলার প্রয়োজন নাই। একটা বিষয় জানতে চাই, আপনি যখন হাজি রহমতু রাজা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ছিলেন তখন কি বই পড়ার সুযোগ ছিল?
জি না।
আপনার বক্তব্য অনুযায়ী আপনি তার সঙ্গে তিন বছর ছিলেন। তাহলে ধরে নিতে পারি এই তিন বছর বই পড়তে পারেন নাই।
ফরিদ জবাব দিল না। হারুন বলল, ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরিতে অনেক বই, এই তথ্য কি আপনি জানেন?
জানি।
কীভাবে জানেন? পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যাওয়ার অভ্যাস কি ছিল?
ফরিদ অস্বস্তি নিয়ে জজ সাহেবের দিকে তাকাল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
আপনি তো সবসময় হাজি সাহেবের সঙ্গেই থাকেন। তাই না?
জি।
হঠাৎ হঠাৎ উনি যখন ময়মনসিংহ আসেন, তখন আপনিও আসেন।
জি।
ক্ষিতিশ বাবু নামে কাউকে চিনেন?
ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, চিনি না।
মনে করার চেষ্টা করুন। উনি ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান।
চিনি না স্যার।
হারুন বলল, আপনি বলছেন চেনেন না, কিন্তু ক্ষিতিশ বাবু ভিন্ন কথা বলেন। তার ভাষ্যমতে আপনি নিয়মিত লাইব্রেরি থেকে বই আনা নেওয়া করেন। আপনি শরৎচন্দ্রের লেখা ‘বিন্দুর ছেলে’ বইটা পড়েছেন?
জি পড়েছি।
পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েছেন?
ইয়াদ নাই।
আপনি সর্বশেষ এই বইটা ইস্যু করেছেন। আপনি থাকেন এক জায়গায়, বই আনা নেওয়া করেন আরেক জায়গায়। ঘটনা কী?
ফরিদ টোক গিলল। তাকাল হাবীবের দিকে। তার চোখে হতাশা।
ঘটনা কি এরকম যে, অন্য একজন খুন করেছে আপনি তার দায়ভাগ সেধে নিচ্ছেন, বিনিময়ে অর্থ পাচ্ছেন?
ফরিদ অস্পষ্ট গলায় বলল, পানি খাব স্যার। তিয়াস লাগছে। জজ সাহেব ইশারায় পানি দিতে বললেন। টিনের গ্লাসে তাকে পানি দেওয়া হলো। ফরিদ তৃষ্ণার্তের মতো পানি খাচ্ছে না। চা খাওয়ার মতো খাচ্ছে।