ভাদু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বারান্দার ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। পাশেই মোড়া পাতা। এতক্ষণ মোড়ায় লাইলী বসে ছিলেন। উনি উঠে যাওয়াতে মোড়া খালি। প্রণব মোড়ায় বসতে বসতে বলল, স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হুঁ। সীতা মেয়েটার সন্ধান পাওয়া গেছে।
প্রণব বলল, সীতা কে?
হাবীব বিরক্ত হয়ে বললেন, সাত খণ্ড রামায়ণ নিজে লিখে এখন বলো সীতা কে? সীতা নারায়ণ চক্রবর্তীর মেয়ে যাকে উদ্ধারের জন্যে তুমি আমার পায়ে ধরলা।
প্রণব লজ্জিত গলায় বলল, ভুলে গেছি।
হাবীব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন মেয়েটার কী ব্যবস্থা করবে করো।
প্রণব বলল, আমি কী ব্যবস্থা করব? মেয়ের বাবা-মা ব্যবস্থা করবে।
হাবীব বললেন, মেয়েটার বাবা-মা কোনো ব্যবস্থা নিবে না। মেয়ের কারণে তারা পতিত হয়েছে। মেয়ে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে ছিল। টানবাজার কী জানো?
না।
বেশ্যাপল্লী। যে মেয়ে বেশ্যাপল্লীতে ছিল, তোমাদের সমাজে তার জায়গা নাই। কথা কি ঠিক?
প্রণব বলল, মেয়েটা আছে কোথায়?
থানা হাজতে। ওসি সাহেব মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তারা মেয়েকে নিবে না। এখন তুমি বলো কী করা যায়?
প্রণব বলল, আমি কী বলব স্যার? আমি বাক্যহারা হয়েছি।
আমি ওসি সাহেবকে বলেছি মেয়েটাকে আমার এখানে দিয়ে যেতে। রাত এগারোটার দিকে আসবে। তুমি মেয়েটাকে চেম্বারে বসাবে। তুমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। যা বলার আমি বলব। আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে এখন কোনো কথা বলব না। তাকে চলে যেতে বলবে।
চেম্বারে সব ক’টা দরজা-জানালা বন্ধু। একটা দরজা খোলা। সেখানে পর্দা দেওয়া। বাইরের বাতাসে পর্দা কাঁপছে। টেবিলে রাখা দুটা মোমবাতির শিখাও কাঁপছে। মোমবাতি ছাড়া ঘরে একটা হারিকেনও আছে। কারেন্ট নেই। মোমবাতি এবং হারিকেনের আলোয় অন্ধকার কমছে না।
সীতা চাদরে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। তার চোখে আতঙ্ক ছাড়া কিছু নেই। মাঝে মাঝে সে কাঁপছে। তার দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। দমকা বাতাসে একটা মোমবাতি নিভে গেল। সীতা প্রবলভাবে কাপল এবং অস্ফুট শব্দ করল, আর তখনই হাবীব ঢুকলেন।
তোমার নাম সীতা?
সীতা জবাব দিল না। তার দৃষ্টি এখনো মোমবাতির শিখার দিকে।
তোমার বাবা মা তোমাকে নিতে রাজি না–এই খবর পেয়েছ?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বললেন, তুমি আমার এখানে থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নাই। থাকবে?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, আমার একটা বুদ্ধি শোনা, কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাও। হিন্দুর গায়ে যতটা দোষ লাগে, মুসলমানের লাগে না। মুসলমান হবে?
সীতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাবীব বললেন, তোমার বয়স অল্প। মাঝে মাঝে অল্প বয়সে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব আগামী বুধবার আসবেন। তার কাছে তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবা। তোমার নতুন একটা নাম লাগবে। তোমার নাম দিলাম হোসনা। হোসনা শব্দের অর্থ সৌন্দর্য। তোমার চেহারা সুন্দর, এই জন্যেই হোসনা নাম।
বাতাসে দ্বিতীয় মোমবাতিটাও নিভে গেল। সীতা আবারও চমকে উঠে অস্ফুট শব্দ করল।
শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব এসেছেন। তিনি রোজা ছিলেন। সন্ধ্যাবেলা ইফতার করে মাগরেবের নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে ঘোষণা করলেন এশার নামাজের পর বেতরের নামাজ পড়বেন। তারপর হিন্দু কন্যাকে মুসলমান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কন্যাকে বড়ইপাতা ভেজানো পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। নখ কাটতে হবে।
সীতাকে গোসল দেওয়া হলো। সে জলচৌকিতে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। পীরসাহেব সীতার সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টাও করলেন। তিনি একতরফা বললেন, সীতা শুধু শুনে গেল।
কোরানপাঠ শিখবে। রোজ ফজরের নামাজের পর পাক কোরান পাঠ করবে। কোরানপাঠ শিখে নিবে।
হায়াজ নেফাসের পর অপবিত্র চুল সব ফেলতে হবে। একটা চুল থাকলেও শরীর শুদ্ধ হবে না।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে পীরসাহেব গলা নামিয়ে আরও কিছু কথা বললেন! সবই অত্যন্ত অশ্লীল কথা। কোনোভাবেই একটি মেয়েকে বলা যায় না। পীরসাহেব অবলীলায় বলে গেলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নোংরা কথাগুলি বলে আনন্দ পাচ্ছেন।
এশার নামাজের পর হাজেরা বিবি ভীষণ হৈচৈ শুরু করলেন। হাবু রে, হাবু রে, হাবু রে।
হাবীব মার কাছে গেলেন। শান্তগলায় বললেন, মা, তোমার সমস্যা কী?
হাজেরা বিবি বললেন, সমস্যা আমার না। সমস্যা তোর। শুনলাম নটিপাড়ার এক হিন্দু নটি মেয়ে তুই নিয়া আসছস। তারে এখন মুসলমান বাইনতাছস। নটির আবার হিন্দু-মুসলমান কী? নটি হইল নটি।
মা চুপ করো।
আমি চুপ করব না। তুই চুপ কইরা আমার কথা গুন। শম্ভুগঞ্জের বদ পীরটারে হাছুনের বারি দিয়া বিদায় কর।
কেন?
এই পীররে অনেক দিন ধইরা আমি লক্ষ করছি। হে মেয়েছেলের চোখের দিকে কোনো সময় তাকায় না। তাকায় বুকের দিকে।
মা! তোমার যন্ত্রণায় আমি অস্থির।
তুই আমার যন্ত্রণায় অস্থির না। আমি তোর যন্ত্রণায় অস্থির। তুই এক্ষণ বুনিচাটা পীর বিদায় করবি। কতবড় হারামজাদা! চউখ দিয়া বুনি চাটে।
কিছুক্ষণের জন্যে হাবীব বিভ্রান্ত হলেন
মেয়েটা কি সফুরা? ফরিদের বউ!
কিছুক্ষণের জন্যে হাবীব বিভ্রান্ত হলেন। ভ্রান্তি কাটতে সময় লাগল না। মেয়েটা সফুরাই। হলুদ চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। চাদর থেকে হলুদ আভা পড়েছে মুখে। সামান্য আলোছায়া কী করতে পারে ভেবে হাবীব যথেষ্ট বিস্ময় বোধ করলেন। সফুরা রূপবতী, কিন্তু এতটা রূপবতী না যে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। অতি রূপবতীরা বর পায় না। সফুরা বর পেয়েছে। কাজেই সে অতি রূপবতীর একজন না। হাবীব কোর্টের কর্মকাণ্ডে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন।