হাবীব মামলার নথির পাতা উল্টাচ্ছেন। মন বসাতে পারছেন না। হাজেরা বিবির গলার আওয়াজ আসছে। ভাঙা রেকর্ডের মতো তিনি ডেকেই যাচ্ছেন। হাবু, হাবু, ও হাবু।
নাদিয়া সিঁড়ি বেয়ে পানির কাছাকাছি চলে গেল। দিঘির জলে ছায়া দেখতে ইচ্ছা করছে। যদিও সে জানে এখন ছায়া পড়বে না। সূর্যের অবস্থান ঠিক নেই। নাদিয়া বুঝতে পারল না দূর থেকে একজন তাকে লক্ষ করছে। তার নাম ভাদু মিয়া। একজনের মনের কথা অন্যজন ধরতে পারে না। ধরতে পারলে নাদিয়া অবশ হয়ে যেত। ভাদু মিয়া প্রকাণ্ড একটা কাঠালগাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। নাদিয়ার ওপর থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এখনই মেয়েটার মুখ চেপে ধরে বাগানের ভেতরের কোনো আড়ালে চলে যেতে। কাজ সমাধার পর দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়া। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলাল। এখন না, আরও পরে। দিনের আলোয় ঘটনা ঘটালে তার ভালো লাগত। কিন্তু ঘটনা ঘটাতে হবে রাতে। ঘটনার পর কিছুক্ষণ মেয়েটার গলা টিপে ধরে রাখতে হবে, তারপর ফেলে দিতে হবে দিঘির পানিতে। এটা কোনো ব্যাপারই না।
ভাদু মিয়া দেখল মেয়েটা উঠে আসছে। সে চট করে গাছের আড়ালে সরে গেল। নাদিয়া বলল, কে? গাছের পেছনে কে?
ভাদু মিয়া বের হয়ে এল। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। মেয়েটা যেন তার চোখ দেখতে না পায়। মেয়েরা চোখ দেখে অনেক কিছু বুঝে ফেলে। তাকে চোখ দেখতে দেওয়া যাবে না।
নাদিয়া বলল, আপনি কে?
আমি নতুন কাজ পাইছি। আমার নাম ভাদু মিয়া।
গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন কেন?
আপনারে দেইখা শরম পাইছি।
আমাকে দেখে শরম পাওয়ার কী আছে?
মেয়েছেলে দেখলে আমি শরম পাই।
নাদিয়া হেসে ফেলল। মহিষের মতো জোয়ান একজন, সে মেয়েছেলে দেখলে শরম পায়। কত বিচিত্র মানুষই না এই পৃথিবীতে আছে!
আমাকে দেখে শরম পাওয়ার কিছু নেই। আমি এ বাড়ির মেয়ে। আমার নাম নাদিয়া। আপনাকে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আপনি আমার দিকে তাকাতে পারেন।
ভাদু মিয়া বলল, জে-না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি শরম পেতে থাকুন।
ভাদু মনে মনে বলল, শরম কারে কয় তুমি বুঝবা। সবুর করোগো সোনার কইন্যা। সবুর।
হাজেরা বিবির সামনে বিরক্তমুখে হাবীব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, সারাক্ষণ আমাকে ডাকো কেন মা?
হাজেরা বিবি বললেন, তোরে ছাড়া কারে ডাকুম? তোর কামলাগুলারে ডাকুম?
কিছু বলবেন?
হুঁ।
বলেন শুনি।
এখন ইয়াদ আসতেছে না। তুই আমার সামনে ব’। আমি ইয়াদের চেষ্টা নেই।
হাবীব বললেন, আপনি ইয়াদ করেন। যদি ইয়াদে আসে আমারে ডাকবেন। আমার কাজ আছে আমি যাই।
ইয়াদ হইছে। তুই ‘ব’ দেহি। তোরে বলতেছি। কথাটা গোপন। কাছে আয়।
আর কাছে আসতে পারব না। আপনার যা বলার বলেন।
কথাটা তেজিল্লী বিষয়ে।
কী কথা?
তোর মেয়ে শাদি করেছে।
আপনাকে নাদিয়া বলেছে?
আমারে কেউ কিছু বলে না। যা বুঝার আমি অনুমানে বুঝি।
অনুমান করলেন কীভাবে?
গন্ধ দিয়া অনুমান করেছি। কুমারী মেয়ের শরীরের গন্ধের এক ভাও, বিয়া হউরা মেয়ের আরেক ভাও। আবার গাভিন মেয়ের অন্য ভাও। কথায় আছে—
কুমারী কন্যার ঘ্রাণ হইল
পানের কচি পাতা
বিয়া হউর কন্যা হইল
পাকনা ফল আতা
গর্ভিনি নারীর শইলে টক ঘ্রাণ পাই
বিধবা নারীর শইলে কোনো গন্ধ নাই।
হাবীব বললেন, আমাকে বলেছেন ঠিক আছে। এই জাতীয় কথা আর কাউকে বলবেন না।
আচ্ছা বলব না। হাজেরা বিবি পান ছেঁচনি নিয়ে বসলেন। টক টকাস শব্দ হতে থাকল।
ভাদু মিয়াও শব্দ করছে। সে কুড়াল দিয়ে কাঠ ফেড়ে রান্নার খুড়ি বের করছে। কেউ তাকে কাঠ ফাড়তে বলেনি। বিশ্বাস অর্জনের জন্যে নিজ থেকে আগ্রহ নিয়ে এইসব কাজ করতে হয়। সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো নিজেকে বোকা হিসেবে দাঁড় করানো। বুদ্ধিমানকে কেউ বিশ্বাস করে না। বোকাকে বিশ্বাস করে। বোকা সাজা কঠিন কোনো কাজ না।
প্রণব গায়ে তেল মাখছিলেন। কাঠ ফাড়া শেষ করে ভাদু প্রণবের সামনে দাঁড়াল। প্রণব বললেন, কিছু বলবি?
ভাদু বলল, গায়ে তেল দিয়া দেই?
না। মুসলমানের হাতের ভলা নেওয়া নিষেধ। মন্ত্র নিয়েছি তো। মন্ত্র নেওয়ার পর নানান বিধিনিষেধ।
মন্ত্র কী?
ঈশ্বরের নাম। কানে একটা নাম গুরু দিয়ে দেন। সেই নাম জপ করতে হয়।
কী নাম?
কী নাম সেটা তো বলতে পারব না। নিষেধ আছে।
আমি কাউরে বলব না।
নাম জেনে তুই করবি কী? নাম জপ করবি?
ক্যামনে জপ করতে হয় শিখায়া দিলে করব। কাজ শিখায়া দিলে আমি পারি। না শিখাইলে পারি না।
কথাবার্তা শুনে তোকে তো বিরাট গাধা মনে হচ্ছে।
অদু বলল, জে-না আমি গাধা না। আমার বুদ্ধি আছে। আপনার শইলে তেল ডইলা দেই?
একবার তো বলেছি, না।
আরাম পাইবেন।
গাধা চুপ কর।
ভাদু মনে মনে হাসল। তার গাধা পরিচয়টা দ্রুত স্থায়ী করতে হবে। গাধা সাজতে হলে একই কথা কমপক্ষে তিনবার বলতে হবে। শরীরে তেল মাখার কথা দু’বার বলা হয়েছে। আরও একবার বলা দরকার। তৃতীয়বারের জন্যে ভাদু অপেক্ষা করছে। অপেক্ষাতেই আনন্দ।
পাংখাপুলার রশিদ এসে প্রণবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বড় সাব আপনেরে ডাকে।
প্রণব বিরক্ত হয়ে বললেন, কানাকানি করতেছ কেন? উনি আমারে ডাকেন এইটা গোপন কোনো কথা না। মেয়েছেলে কানে কথা বলতে পছন্দ করে। তুমি মেয়েছেলে না।
ভাদু আনন্দিত গলায় বলল, অত্যধিক সত্য কথা। সে মেয়েছেলে না।
প্রণব বলল, এই বেকুব, সব কথায় কথা বলবি না।