ফরিদ।
কিছু চাও?
জে না।
কিছু চাও না, তাহলে আমার বাড়ির গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
জে না।
এই বাড়ির কাউকে চেনো?
না।
ঠিকমতো বলো, চুরি-ডাকাতির ধান্দা আছে?
ফরিদ বলল, স্যার, আমি আরাম করে একবেলা ভাত খেতে চাই।
দুপুরের খাওয়া হয় নাই?
না।
সকালে কী খেয়েছ?
মুড়ি।
ভাত খাও না কত দিন?
তিন দিন।
করো কী?
ফার্মেসিতে চাকরি করতাম। চাকরি চলে গেছে।
চাকরি কী জন্যে গেছে? চুরি করেছিলা?
জি।
কত টাকা চুরি করেছিলা?
দুইশ টাকা আর কিছু ওষুধ।
টাকা এবং ওষুধ কাকে পাঠায়েছিলা?
স্যার, আমার মাকে। উনার টিবি হয়েছিল।
উনি কি বেঁচে আছেন?
জি-না। উনার ইন্তেকাল হয়েছে।
বাবা কি জীবিত?
জি-না।
আসো আমার সঙ্গে। চেম্বারে গিয়ে বসো। খানা হতে দেরি হবে। অপেক্ষা করে। কী খেতে চাও?
কষানো মুরগির সালুন আর চিকন চালের ভাত।
আর কিছু না?
জি-না।
চেম্বারের সামনের বেঞ্চিতে ফরিদ জবুথবু হয়ে বসে রইল। বৃষ্টি নেমে গেছে। সে বৃষ্টি দেখছে। রাতে সে আরাম করে খেতে পারবে—এই আনন্দেই তার চোখে পানি এসে গেছে। চোখের পানি আটকানোর কোনো চেষ্টা সে করছে মা। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে দেখবে।
ফরিদের বয়স পঁচিশ। অসম্ভব রোগা একজন মানুষ। মাথার চুল কোঁকড়ানো। চোখ বড় বড়। সে মেট্রিকে তিনটা লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল। কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। সংসার চালানোর জন্যে ফার্মেসিতে চাকরি নিতে হয়েছিল।
হাবীব ফরিদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। ঘরে মুরগি ছিল না। তিনি কষানো মুরগি রাধতে বললেন। কালিজিরা চালের ভাত করতে বললেন। রশিদকে বলে দিলেন, ফরিদকে থাকার জন্যে যেন একটা ঘর দেওয়া হয়। যতদিন ইচ্ছা সে থাকবে। খাওয়াদাওয়া করবে।
রশিদ বিস্মিত হয়ে তাকাল। হাবীব বললেন, বড় বড় বাড়ির শোভা হচ্ছে কিছু উটকা মানুষ। আশ্রিত মানুষ। এরা বাড়ির সঙ্গে যুক্ত না। কোনো কাজেকর্মে না। থাকবে, খাবে এবং লজ্জিত হয়ে জীবনযাপন করবে। এদের লজ্জাটাই বাড়ির শোভা। বুঝেছি?
জি।
তুমি বোঝে নাই। বোঝার প্রয়োজনও নাই! যা করতে বলেছি করো। এই ধরনের মানুষ কিছুদিন থাকে, তারপর একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। ত্রিশ দিনের মাথায় চলে যায়। এই ছেলেও তাই করবে।
ফরিদ তা করেনি। সে তিন বছর ধরে আছে। সে নিজ থেকেই বাগানের গাছপালা দেখে। নানান জায়গা থেকে গাছ এনে লাগায়। আশেপাশে যখন কেউ থাকে না, তখন নিচুগলায় গাছের সঙ্গে কথা বলে। তেঁতুলগাছের সঙ্গে তার এক দিনের কথাবার্তার নমুনা
আছ কেমন? ছোট হয়া আছ, বিষয় কী? আদরযত্নের কি কমতি হইতেছে? গোবর সার, পচা খইল সবই তো পাইছরে বাপধন। আরও কিছু লাগবে? লাগলে বলে। সর্বনাশ, পাতায় পোকা ধরছে! দাঁড়াও নিমের ডাল দিয়া ঝাড়া দিব। নিমের ডালের ঝাড় হইল কোরামিন ইনজেকশন। তবে তোমার পোকায় ধরা ডাল ফেলে দিব। একটু কষ্ট হবে। উপায় কী?
বিশাল কাতল মাছ রান্না হয়েছে, হাবীব খেলেন না। তার জ্বর এসেছে। জ্বর গায়ে নিয়েই গোসল করেছেন। এতে সামান্য আরাম পাচ্ছেন। ঘুম এসেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন। অসুস্থ অবস্থায় স্বপ্নগুলিও অসুস্থ হয়। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, হাতির পিঠে করে নদী পার হচ্ছেন। নদীতে প্রবল স্রোত। হাতি ঠিকমতো সাঁতরাতে পারছে না। মাহুত মুখে হট হট করছে। হাতি সামলানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।
রাত দশটায় তার ঘুম ভাঙানো হলো। ছোট্ট সমস্যা না-কি হয়েছে। কাজী সাহেব এসেছেন। সব প্রস্তুত। শুধু সফুরা এখন বলছে সে কবুল বলবে না। বিবাহ করবে না। খবর নিয়ে এসেছেন প্রণব বাবু। তাকে চিন্তিত এবং ভীত মনে হচ্ছে।
হাবীব বললেন, বিবাহ করবে না। পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরবে। বড় বাড়ির ইজ্জত নষ্ট করবে।
প্রণব চুপ করে রইলেন।
হাবীব বললেন, নৌকা ঠিক করো। মেয়েটাকে নৌকায় তুলে দাও। নৌকা তাকে ভাটি অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে আসবে। সেখানে সে যা ইচ্ছা করুক। এই জাতীয় মেয়ের স্থান হয় বেশ্যাপল্লীতে। শেষ পর্যন্ত সে সেইখানেই যাবে।
প্রণব বললেন, ফরিদকেও নাওয়ে তুলে দেই, মেয়ের সাথে বিদায় হয়ে যাক।
হাবীব বললেন, না। সে তো বিবাহ করতে রাজি হয়েছে। যে মেয়ে তার সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, সে ভালো মেয়ে না। অন্যের সঙ্গেও সে এই কাজ করতে পারে। তারপরেও ফরিদ বিবাহে মত দিয়েছে, এরে ছোট করে দেখা ঠিক না। তার দোষ এতে কিছু কাটা গেছে। মেয়েটাকে বিদায় করে আমাকে খবর দাও যেন শান্তিমতো ঘুমাতে পারি।
প্রণব চলে গেলেন এবং আধঘণ্টার মধ্যে জানালেন, সমস্যার সমাধান হয়েছে। সফুরার সঙ্গে এক শ’ এক টাকা কাবিনে ফরিদের বিবাহ হয়েছে।
হাবীব বললেন, ভালো।
প্রণব বললেন, আপনার জ্বর কি বেশি? একজন ডাক্তার ডেকে আনি?
হাবীব বললেন, না। মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে বলো। আর জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে স্বপ্নের তফসির নিয়ে আসে। স্বপ্নে আমি হাতির উপর উঠেছি। হাতি নদী পার হচ্ছে। নদীতে প্রবল স্রোত।
রাত প্রায় বারোটা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। শহর অন্ধকার। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাস দিচ্ছে। এখনো বর্ষণ শুরু হয়নি। ফরিদের নবপরিণীতা স্ত্রী চৌকিতে বসে কাঁদছে। তার মুখ জানালার দিকে ফেরানো বলে ফরিদ মুখ দেখতে পাচ্ছে না। চৌকির ওপর মশারি খাটানো। বাতাসে নৌকার পালের মতো মশারি উড়ছে। ফরিদ মশারি ঠিক করতে ব্যস্ত। ঘরে হারিকেন জ্বলছে। তবে হারিকেন দপদপ করছে। যে-কোনো সময় হারিকেন নিভবে। ফরিদ কলল, রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়ো।