খুনের কারণ কি মেয়েমানুষ?
সব শুনি নাই।
হাবীব বললেন, জগতের বড় যত crime তার সবের পেছনে একটা মেয়েমানুষ থাকবে। শুরুতে সেটা মাথায় রাখলে সুবিধা হয়। ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে গেল হেলেন নামের নাকর্বোচা এক মেয়ের জন্যে।
প্রণব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আফসোস!
হাবীব বললেন, তিন ধরনের নারীর বিষয়ে সাবধান থাকতে শাস্ত্রে বলে। সবু নিতম্বের নারী, বোচানাকের নারী আর পিঙ্গলকেশী নারী। এই তিনের মধ্যে
ভয়ঙ্কর হলো পিঙ্গলকেশী।
প্রণব বললেন, আপনার সঙ্গে থাকা শিক্ষাসফরের মতো। এক জীবনে কত কিছু যে শিখলাম।
হাবীব বললেন, আজ জুম্মা পড়তে যাব না। জোহরের নামাজ ঘরে পড়ে নিব। শরীর ভালো ঠেকতেছে না। ঘরে বিশ্রাম নিব।
মক্কেলদের সঙ্গে বসবেন না।
সন্ধ্যার পর বসব। মাগরেবের ওয়াক্তের পরে। তোমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছ? পাক বসাবে না?
প্রণব নিরামিশাষী। স্বপাকে আহার করেন। আজ নানান ঝামেলায় রান্না হয় নাই। প্রণব বললেন, আজ ঠিক করেছি উপাস দিব। মাসে দুই দিন উপাস দিলে শরীরের কলকব্জা ঠিক থাকে। ফকির মিসকিনদের যে রোগবালাই কম হয়, তার কারণ একটাই—তারা প্রায়ই উপাস দেয়।
হাবীব উঠে পড়লেন। প্রণবের সামনে বসে থাকলে সে বকবক করতেই থাকবে। হাবীবের সঙ্গে পাংখাপুলার রশিদও উঠে পড়ল। স্যারের গায়ে সাবান ডলে গোসল দেওয়ার দায়িত্ব তার। রশিদের স্বভাব প্রণবের উল্টা। সে নিজ থেকে কখনো কথা বলে না। সে সবার সব কথা শোনে। আট বছর আগে সে খুনের এক মামলায় ফেঁসেছিল। তার সঙ্গী দু’জনের ফাঁসি হয়েছে, সে বেকসুর খালাস পেয়েছে। হাবীব তাকে পাংখপুলারের কাজ দিয়েছেন।
চেম্বার থেকে বের হয়ে হাবীব ডানদিকে তাকালেন। তার ডানদিকে শেষ প্রান্তে ফরিদের ঘর। টিনের চালের হাফবিল্ডিং। সামনে প্রকাণ্ড অশোকগাছ। লাল ফুলে গাছ ভর্তি। ফরিদ মাথা উঁচু করে ফুলের দিকে তাকিয়ে কাঠের চেয়ারে বসে আছে। হাবীবকে সে দেখেনি। দেখলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াত। তিনি ডাকলেন, ফরিদ।
ফরিদ থতমত খেয়ে গেল। উঠে দাঁড়াতেও ভুলে গেল। হাবীব এগিয়ে গেলেন তার দিকে।
ফরিদ, আছ কেমন?
জি। ভালো।
আজ তোমার বিবাহ। বিবাহের দিন লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বসে আছ, এটা কেমন কথা?
ফরিদ কিছু বলল না। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাবীব বললেন, তোমাকে যে আমি বিশেষ স্নেহ করি এটা জানো?
ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, জানি।
হাবীব বলল, বিশেষ স্নেহ করি বলেই এত বড় অন্যায়ের পরেও তোমাকে কোনো শাস্তি দেই নাই। অন্যায়টা যার সঙ্গে করেছ, তার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দিচ্ছি। এখনো বলো তোমার কোনো আপত্তি কি আছে?
না।
এই মেয়েকে তুমি আগে ব্যবহার করেছ বেশ্যার মতো, এখন সে তোমার স্ত্রী হবে। সেটা খেয়াল রাখবে।
জি, রাখব।
প্রণবকে বলে দিব যেন নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে দেয়। মাথার চুল কাট। বিবাহের দিন চুল কাটা উত্তম সুন্নত।
হাবীব দোতলায় উঠে গেলেন। সিড়ির শেষ মাথায় হঠাৎ তার পা পিছলাল। রশিদ পেছন থেকে দ্রুত ধরে ফেলায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল না। হাবীব সিঁড়ির শেষ ধাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই দুর্ঘটনা আজ প্রথম ঘটেনি। আগেও দু’বার ঘটেছে এবং একই জায়গায় ঘটেছে। এর মধ্যে কি কোনো ইশারা আছে?
রশিদ বলল, স্যার দুঃখু পাইছেন?
না। আজ তোমার পাংখা টানাটানি করতে হবে না। ফরিদের বিবাহের ব্যাপারটা দেখো।
জে আচ্ছা।
আরেকটা কাজ করো। মাওলানা সাহেবরে খবর দাও। তিনি যেন দেয়া পড়ে সিঁড়িটাতে ফুঁ দেন। এই সিঁড়িতে দোষ আছে।
জে আচ্ছা।
ফরিদের সঙ্গে যার বিবাহ হবে তার নামটা যেন কী? হঠাৎ করে নাম বিস্মরণ হয়েছি।
তার নাম সফুরা।
আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও।
রশিদ সঙ্গে সঙ্গে গেল না। হাবীবকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে ফ্যান ছাড়ল। ইলেকট্রিসিটি আছে। সিলিং ফ্যান বিকট শব্দ করে ঘুরছে।
রশিদ বলল, পানি খাবেন স্যার। এক গ্লাস পানি দিব?
না।
সিনান কখন করবেন?
পানি গরম দাও, খবর দিব। ভালো কথা, চুল কাটার পর ফরিদকে ভালোমত সাবান ডলে গাল দিবা।
জি আচ্ছা।
জীবনে তিনবারের গমন অতি গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর, বিবাহের দিল এবং মৃত্যুর পর। এই তিন গোসলেই বড়ইপাতা লাগে, এইটা জানো?
জে না।
তবে আজকাল জনের পরের গোসল আর বিবাহের গোসল—এই দুই শামলে বইপাতা ব্যবহার হয়না। কেন হয়না কে জানে!
ফরিদ ভাইরে কি বইয়ের পাতা দিয়া গোসল দিব?
দাও।
হাবীব বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শরীর ছেড়ে দিয়েছে। জ্বর আসার আগে আগে শরীর ছেড়ে দেয়। মক্কেলদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় বসতে পারবেন–এইরকম মনে হচ্ছে না। বমি বমি ভাবও হচ্ছে। এত বড় মাছের টুকরাটা খাওয়া ঠিক হয় নাই।
উপন্যামের এই পর্যায়ে ফরিদের এ বাড়িতে আগমন এবং স্থায়ী হওয়ার ঘটনা বলা যেতে পারে। মাতাল হাওয়ায় ফরিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুরু। মাঝে। মাঝে গুরুত্বহীন মানুষকে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। অভাজন হয় যান বিশেষ জন।
শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যাবেলা। হাবীব মসজিদে মাগরীবের নামাজ শেষ করে। ফিরছেন। রশিদ ছাতা হাতে তাঁর পেছনে পেছনে আসছে। ছাতার প্রয়োজন ছিল না। বৃষ্টি পড়ছে না। তবে আকাশের অবস্থা ভালো না। মেঘ ডাকাডাকি করছে। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ছাতা মেলে প্রস্তুত থাকা ভালো।
হাবীব বাড়ির গেটের সামনে থমকে দাঁড়ালেন।গেটে হাত রেখে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবক তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেট ছেড়ে সরে দাঁড়ান। অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করল। মনে হয় সালাম দিল। হাবীব বললেন, কে? নাম কী?