ক্ষিতিশ বাবু বললেন, হয় নাই। শেষ স্বাধীন নবাবের নাম মীর কাশেম।
মীর কাশেম?
হ্যাঁ মীর কাশেম। ক্লাইভের গর্ধব মীর জাফরের পর মীর কাশেম সিংহাসনে বসেন। তিনি ইংরেজবিদ্বেষী স্বাধীনচেতা নবাব ছিলেন। পড়াশোনা করার এই এক লাভ। আমজনতা যেটা জানবে তার চেয়ে বেশি জানা।
ফরিদ বলল, জেলখানায় কি লাইব্রেরি আছে?
ক্ষিতিশ বাবু চোখ সরু করে বললেন, জেলখানার লাইব্রেরির খোঁজ নিচ্ছে কেন? জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
জি।
কী অপরাধে জেলে যাবে?
খুনের অপরাধে।
ক্ষিতিশ বাবু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বললেন, কাকে খুন করেছ?
ফরিদ বলল, যাকে খুন করেছি তার নাম জানি না।
কীভাবে খুন করেছ? গলা টিপে?
গুলি করেছি।
কী কারণে গুলি করেছ?
বন্দুক পরিষ্কারের সময় হঠাৎ গুলি বের হয়েছে।
কোথায় খুন করেছ?
বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে ফরিদ বলল, কোথায় খুন করেছি আমি জানি না।
ফরিদ যে শুধু ক্ষিতিশ বাবুর জন্যে ধুতি কিনেছে তা নয়, সে তার স্ত্রীর জন্যে লালপাড় টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি কিনেছে। প্রণবের জন্যে ঘিয়া রঙের চাদর কিনেছে।
প্রণব চাঁদর হাতে নিয়ে বললেন, তোমার খরচের হাত খারাপ না। আজ টাকা পেয়েছ, আজই বাজারসদাই শুরু করেছ। কথায় আছে—
হাতে আসছে টাকা
এক দিনে ফাঁকা
দুই দিনে ধার
তিন দিনে গঙ্গা পাড়।
যাই হোক, চাদরটা ভালো কিনেছ। একটা চাদরের প্রয়োজনও ছিল! ভগবান তোমার মঙ্গল করুক। ভগবান আমার কথায় কিছু করবে না। নিজের ইচ্ছায় যদি করে।
ফরিদের স্ত্রী সফুরা শাড়ি কোলে নিয়ে বসে আছে। ফরিদ বলল, রঙ পছন্দ না হলে বদলায়ে দিবে।
সফুরা বলল, রঙ পছন্দ হয়েছে।
রঙ পছন্দ হলে মুখ বেজার কেন?
বুঝতেছি না কেন।
ফরিদ টাকার বান্ডেল এগিয়ে দিতে দিতে বলল, এখানে দুইশ কম পাঁচ হাজার টাকা আছে। তোমার কাছে রাখো। ইচ্ছামতো খরচ কোরো।
টাকা কই পেয়েছেন? চুরি করেছেন?
না। রোজগার করেছি।
কী কাজ করে রোজগার করলেন?
একটা মানুষ খুন করে টাকাটা পেয়েছি। ঘটনা আরেকদিন বলব। আজ না। এখন যাও, নয়া শাড়ি পইরা আসো। তোমারে দেখি।
আপনি মানুষ ভালো।
সব মানুষই ভালো। অতি মন্দ মানুষের মধ্যেও থাকে অতি ভালো। মন্দ এবং ভালো মিলে সমান সমান হয়। আমার কথা না। বই পড়ে শিখেছি।
কথা ঠিক না। বই পইড়া ভুল কথা শিখেছেন। একজন মন্দ মানুষের সবটাই মন্দ। একজন ভালো মানুষের সবটা ভালো। আমার দিকে তাকায়ে দেখেন। আমার সবটাই মন্দ। চেহারা শুধু সুন্দর।
যাও শাড়িটা পরে আসো। নয়ন ভইরা দেখি। বেশিদিন তোমারে দেখব না।
সফুরা উঠে গেল। অসময়ে স্নান করল। সময় নিয়ে সাজতে বসল। ফরিদ নামের অতি ভালো মানুষটার সামনে আজ সে পরী সেজে দাঁড়াবে। গুনগুন করে একটা গীতও করবে–
মন পবনের নাওয়ের মাঝি
কই তোমারে কথা
তোমারে না। আমি
দুঃখ বারতা…
গীত শুনে মানুষটা চমকাবে। কারণ সফুরা যে গীত জানে মানুষটা জানে না।
লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ
লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যখন প্রথম পড়তে আসি তখন আমার বাবা এক সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে কিছু উপদেশ দিলেন। তাঁর উপদেশের সারমর্ম হচ্ছে—এখন তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা। তোমাকে দেখার কেউ নেই। হলে একা একা থাকবে। যা তোমার করতে ইচ্ছা করে করবে। ছাত্ররাজনীতিতে জড়াবে না। আমি দরিদ্র পুলিশ ইন্সপেক্টর, আমি যেন বিপদে না পড়ি।
আমি বললাম, আচ্ছা।
বাবা বললেন, তোমার বুদ্ধি ভালো, মেধা ভালো। আমি চাই তুমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিবে। CSP হবে। কোনো একসময় আমার এলাকা তুমি পরিদর্শনে আসবে। তখন আমি তোমাকে স্যালুট দিব।
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, এইগুলি কী ধরনের কথা! বাপ ছেলেকে স্যালুট করবে কোন দুঃখে?
বাবা বললেন, এইসব তুমি বুঝবে না আয়েশা। বাপ-ছেলের কোনো বিষয়, এটা হলো অফিসারের সঙ্গে অফিসারের বিষয়।
বাবা আমাকে চিঠি লিখতেন ইংরেজিতে। সেইসব চিঠির উত্তরও আমাকে ইংরেজিতে লিখতে হতো। যাতে CSP পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে আমার ইংরেজিটা সড়গড় হয়। তাঁকে ইংরেজিতে চিঠি লেখায় সমস্যা ছিল। তিনি প্রতিটি ভুল লালকালিতে দাগিয়ে আমার কাছে ফেরত পাঠাতেন।
তিনি কঠিন পাকিস্তানভক্ত অফিসার ছিলেন। তিনি তার এই ভক্তি কিছুটা হলেও আমার মধ্যে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার মতো আমার কাছেও মনে হতো, লৌহমানব আয়ুব খান একজন যোগ্য শাসক। পূর্বপাকিস্তানের নেতারা ঝামেলা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারেন না। তাদের কারণেই দেশের শান্তি বিনষ্ট হয়। অগ্রগতি থমকে যায়।
বাবার ধারণা নেতাদের মধ্যে মাওলানা ভাসানী কিছুটা ছাড় পেতে পারেন, কারণ হুজুরের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি দেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আগেভাগে জেনে ফেলেন। পুলিশের স্পাই হিসেবে একবার বাবাকে দীর্ঘসময় মাওলানা ভাসানীর সহযাত্রী হিসেবে ট্রেনভ্রমণ করতে হয়েছে। এই ট্রেনযাত্রাই তার জন্যে কাল হলো। মাওলানা ভাসানীর জন্যে তাঁর হৃদয়ে কোমল স্থান তৈরি হলো। তিনি বলা শুরু করলেন, মাওলানা ভাসানীকে সাধারণ হিসাবে ফেলা যাবে না। তিনি অনেক বেফাঁস কথা বলবেন, সেই বেফাঁস কথাই আসল কথা।
আমি বাবার আদর্শে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লাম। সব পিতাই অন্যায়ভাবে সন্তানের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে চান। ইঞ্জিনিয়ার পিতা পুত্রকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করেন। ডাক্তার পিতার ছেলে ইচ্ছা না থাকলেও ডাক্তারি পড়ে। পাশ করার পর বেজার মুখ করে রোগী দেখে। কসাইয়ের ছেলে আশা করে তার ছেলে হবে বিখ্যাত কসাই। আধঘণ্টায় গরুর চামড়া ছিলে কেটেকুটে ফেলবে।