নাদিয়া বলল, ঘরে চলো দাদি।
হাজেরা বিবি বললেন, ঘরে যাব না। এইখানে বইসা থাকব।
আমি চলে যাই।
যা ইচ্ছা কর।
নাদিয়া দোতলা থেকে একতলায় নামল। রান্নাঘরের দরজা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লাইলী বলল, ধুয়ার মধ্যে থাকিস না মা। গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যাবে।
নাদিয়া বলল, তুমি তো জীবনের বেশির ভাগ সময় রান্নাঘরে কাটিয়ে দিয়েছ, তোমার গায়ের রঙ কাচাহলুদের মতো।
লাইলী বললেন, বিয়ের আগে কুমারী মেয়েদের গায়ে ধুয়া লাগলে গায়ের রঙ ময়লা হয়। বিয়ে হয়ে যাবার পর আর রঙ বদলায় না।
নাদিয়া হাসছে। লাইলী বললেন, হাসছিস কেন?
নাদিয়া বলল, তোমার উদ্ভট কথা শুনে হাসছি। তুমি এমন একজনকে কথাগুলি বলছ যে ফিজিক্সের ছাত্রী। এবং ফেলটুসমার্কা ছাত্রী না। খুব ভালো ছাত্রী।
লাইলী বললেন, রান্নাঘর থেকে যা তো মা।
নাদিয়া বের হলো। রওনা হলো দিঘির ঘাটের দিকে। সে ঠিক করেছে প্রথম দিনের মতো নিঃশব্দে যাবে। তাকে দেখে মানুষটা যখন চমকে উঠবে তখন সে ঠান্ডা গলায় বলবে, আচ্ছা আপনি কি আপনার বাবাকে গুলি করে মেরেছেন?
নাদিয়া দিঘির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘাটের সিঁড়িতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে মানুষটা বই পড়ছে। তার চোখে পানি। বানানো দুঃখের গল্পে যে অশ্রুবর্ষণ করে সে প্রিয়জনদের দুঃখে কখনো অশ্রুবর্ষণ করবে না।—কথাটা যেন কার? কিছুতেই মনে পড়ছে না। মানুষটা কী বই পড়ছে জানতে ইচ্ছা করছে। ম্যাথমেটেশিয়ান আবেল (Abel) অংকের জটিল কোনো বই পড়লে মুগ্ধ হয়ে অবর্ষণ করতেন।
কেমন আছেন?
মানুষটা ঠিক ওইদিনের মতো চমকে উঠল। তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। বইয়ের নাম তিথিডোর। লেখক বুদ্ধদেব বসু। এই বই নাদিয়ার পড়া নেই। বইটা পড়তে হবে।
নাদিয়া বলল, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
হাসান বলল, বসুন।
নাদিয়া বসতে বসতে বলল, দিঘির এই ঘাটটা মনে হয় আপনার খুব পছন্দ?
হাসান বলল, জি।
আপনাদের নিজের বাড়িতে কি এরকম ঘাট আছে?
হাসান বলল, দিঘির ঘাট নেই, তবে হাওরের সঙ্গের ঘাট আছে। আমাদের বাড়ির পেছনে ঘাট। বর্ষার সময় এই ঘাটটা আমার কাছে তাজমহলের চেয়েও সুন্দর মনে হয়।
আপনি কি তাজমহল দেখেছেন?
দেখেছি। আমাদের বাড়িটাও খুব সুন্দর। বাড়ির নামটাও সুন্দর। কইতরবাড়ি।
কী বাড়ি?
কইতরবাড়ি। কইতর হলো কবুতর। বাড়িটার নানান খুপড়িতে শত শত কবুতর বাস করে। আপনি যদি দোতলার বারান্দায় কাকতাড়ুয়ার মতো দুই হাত মেলে দাঁড়ান দুই হাতে কবুতর এসে বসবে। বকম বকম করে ডাকতে থাকবে। কী যে সুন্দর দৃশ্য।
নাদিয়া অবাক হয়ে গল্প শুনছে। অবাক হবার প্রধান কারণ হাসান নামের মানুষটার নিজের বাড়ি সম্পর্কে মুগ্ধতা।
হাসান বলল, আমি আপনাকে অনুরোধ করব এক রাত আমাদের বাড়িতে থেকে আসতে। একবার যদি যান বাকিজীবন এই বাড়ির কথা আপনার মনে থাকবে। স্বপ্নেও আপনি এই বাড়ি দেখবেন।
নাদিয়া বলল, আমি যাব। আচ্ছা আপনার বাবা কি বেঁচে আছেন?
হাসান বলল, হ্যাঁ। উনি এখন ময়মনসিংহেই আছেন। আমি বাবাকে বলব যেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমি সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আমি সঙ্গে যেতে পারব না।
পারবেন না কেন?
আমি বিরাট এক ঝামেলায় পড়েছি। ঝামেলা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।
কথা বলতে না চাইলে কথা বলতে হবে না। আচ্ছা শুনুন, তিথিভোর’ বইটা আপনার পড়া শেষ হওয়ার পর আমাকে দেবেন। আমি পড়ে দেখব চোখের পানি ফেলার মতো কী আছে। এখন পর্যন্ত কেনো গল্পের বই পড়ে আমার চোখে পানি আসেনি।
হাসান বলল, বইটা আপনি নিয়ে যান। আপনি পড়ে শেষ করার পর আমি পড়ব। প্লিজ।
নাদিয়া হাত বাড়িয়ে বই নিল। হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন আপনি ঘাট ছেড়ে চলে যান। আপনি যেখানে বসে যে ভঙ্গিতে বইটা পড়ছিলেন আমি সেইভাবেই পড়ব। আপনি সর্বশেষ কোন পাতাটা পড়ছিলেন বের করে দিন। আমি পাতাটা ভাজ করে রাখব। দেখব এই পাতাটা পড়ার সময় চোখে পানি আসে কি না।
হাসান পাতা বের করতে করতে বলল, আপনি প্রণব বাবুকে জোনাকির ঝাঁকে জোনাকির সংখ্যা গুনতে বলেছিলেন। আমি তিনটা ঝাক গুনেছি। একটাতে জোনাকির সংখ্যা সতেরো, একটাতে নয়, আরেকটাতে পাঁচ।
নাদিয়া বলল, সব বেজোড় সংখ্যা? আশ্চর্য তো!
হাসান বলল, সাতরা পাখি বলে একধরনের পাখি আছে, এদের দলে সব সময় সাতটা পাখি থাকে। তার কমও না, তার বেশিও না।
নাদিয়া বলল, তাই না-কি?
হ্যাঁ তাই।
এটা আমি জানতাম না। আপনার কাছে কি তাশ আছে? খেলার তাশ।
হাসান আশ্চর্য হয়ে বলল, না তো।
নাদিয়া বলল, দুই প্যাকেট তাশ জোগাড় করে রাখবেন। আমি তাশের ম্যাজিক দেখাব? এখন চলে যান।
সন্ধ্যা সাতটা।
ফরিদ পাবলিক লাইব্রেরিতে। ক্ষিতিশ বাবুর সামনের চেয়ারে বসে আছে। সে ক্ষিতিশ বাবুর জন্যে গরম সিঙ্গাড়া এবং আলুর চপ নিয়ে এসেছে। ক্ষিতিশ বাবু অবাক হয়ে তাকালেন। ফরিদ বলল, আমার নিজের রোজগারের টাকায় কিনা। আপনি খান।
রোজগার শুরু করেছ?
জি।
উত্তম। অতি উত্তম।
ফরিদ নিচুগলায় বলল, আপনার জন্যে একটা ধুতি কিনে এনেছি। যদি নেন খুবই খুশি হব।
ক্ষিতিশ বাবু সিঙ্গাড়া মুখে দিতে দিতে বললেন, তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে নিব। জবাব দিতে না পারলে ধুতি নিয়া বাড়িত যাবা। প্রশ্নটা হলো—বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাবের নাম কী?
ফরিদ বলল, সিরাজউদ্দৌলা।