ফরিদ বলল, কতদিন জেলে থাকতে হবে স্যরি?
হাবীব বললেন, খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। এখন তুমি বলো, একজন মানুষের জীবনে পাঁচ বছর কি খুব বেশি সময়?
জি-না স্যার।
ঘটনাটা মন দিয়ে শোনো, তুমি একজনের অ্যাসিসটেন্ট। তোমার যে মুনিব তার শিকারের শখ। তিনি ভোরবেলা শিকারে যাবেন। তোমাকে দুনলা বন্দুক পরিষ্কার করতে বললেন। তখন দুর্ঘটনা ঘটল। বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে গেল। একজন মারা গেল।
ফরিদ বলল, যিনি মারা গেলেন তার নাম কী স্যার?
হাবীব বললেন, তার নাম দিয়ে তোমার প্রয়োজন নাই। জীবিত মানুষের নামের প্রয়োজন, মৃত মানুষের নামের প্রয়োজন নাই। আদালতে দুর্ঘটনার মামলা হবে। সাজা পাঁচ বৎসরের বেশি হওয়ার কোনো কারণ নাই।
ফরিদ বলল, সাজা বেশি হলেও কোনো ক্ষতি নাই স্যার।
হাবীব বললেন, প্রণব আজ বিকালে তোমাকে জমি দেখাবে। জমি তোমার স্ত্রীর নামে আগামীকাল রেজিস্ট্রি হবে। জেল থেকে বের হয়ে এসে তুমি ঘর তুলে থাকবে।
হাবীব প্রণবকে ইশারা করলেন। প্রণব উঠে গেলেন। ড্রয়ার থেকে টাকার বান্ডিল বের করলেন। পাঁচ টাকার নোটে পাঁচ হাজার টাকা। হাবীব বললেন, টাকা ভালোমতো গুণে দেখা।
ফরিদ বলল, গুণতে হবে না স্যার।
হাবীব বললেন, অবশই গুণতে হবে।
ফরিদ টাকা গুণছে। হাবীব প্রণবের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আরেকটা পান দাও। দোতলা থেকে হাজেরা বিবি চেঁচাচ্ছেন, ও হাবু! হাবুরে! হাবু কই গেলি? হাবীব বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকালেন।
হাজেরা বিবির কাছে নাদিয়া উপস্থিত হয়েছে। নাদিয়া বলল, দাদি, কী হয়েছে?
হাজেরা বিবি বললেন, আমার খাটের নিচে আজরাইল বইসা আছে।
নাদিয়া বলল, উনাকে কী করতে বলব? চলে যেতে বলব? না-কি খাটের উপর এসে বসতে বলব?
হাজেরা বিবি কঠিন গলায় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। হেসে ফেললেন। নাদিয়া বলল, হাসছ কেন দাদি?
হাজেরা বিবি বললেন, তোর বদামি দেইখা হাসলাম। তুই বিরাট দুষ্ট হইছস।
নাদিয়া বলল, তুমিও অনেক দুষ্ট দাদি। সারাক্ষণ সবাইকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। আজরাইল আজরাইল। দিনেদুপুরে আজরাইলের কথা বললে কি কেউ ভয় পাবে? নিশিরাতে বলে দেখতে পারো।
আমারে বুদ্ধি দিবি না। আমার বুদ্ধির প্রয়োজন নাই।
হাজেরা বিবি নাতনিকে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন। নাদিয়া বসল। হাজেরা বিবি বললেন, গোপন কথা শুনতে মন চায়? এমন এক গোপন কথা জানি, শুনলে শইলের সব লোম খাড়ায়া যাবে।
নাদিয়া বল, গোপন কথা শুনতে চাই না।
শুনতে চাস না কেন? আসল মজা গোপন কথার মধ্যে।
নাদিয়া বলল, দাদি, একেকজনের আসল মজা একেকরকম। মা’র আসল মজা রান্নাবান্নাতে, বাবার মজা প্যাঁচ খেলানোয়।
হাজেরা বিবি বললেন, এমন কেউ কি আছে যার কোনো মজা নাই?
থাকতে পারে। আমি জানি না।
নাদিয়া উঠে দাঁড়াল। হাজেরা বিবি বললেন, যাস কই? ঠান্ডা হইয়া বস। গফ করি।
নাদিয়া বলল, আমি বারান্দার কাঠের চেয়ারে ঠান্ডা হয়ে বসব। বারান্দায় বসে আমি অনেক মজা পাই।
কী মজা পাস?
বারান্দায় বসে সবাইকে দেখি। কেউ আমাকে দেখে না। এর অন্যরকম মজা।
হাজেরা বিবি বললেন, আমারে সাথে নিয়া চল। আমি তোর সাথে মজা দেখব।
নাদিয়া দাদিকে হাত ধরে খাট থেকে নামাল। নাদিয়ার কাধে ভর দিয়ে তিনি দোতলার বারান্দায় চলে এলেন। টানা বারান্দার একপ্রান্তে তিনটা ভারী হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার। বারান্দা ঘেঁসে কাঠালগাছ। প্রাচীন এই গাছ বারান্দায় অশ্রু তৈরি করেছে। বারান্দায় কেউ বসেছে কি না, চট করে বোঝা যায় না।
হাজেরা বিবি বসতে বসতে বললেন, কী মজা দেখাবি দেখা।
নাদিয়া বল্ল, ওই দেখো রশিদ ভাই। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
হাজেরা বিবি বললেন, এটা দেখার মধ্যে মজা কী?
একটা মানুষ গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে, এটা দেখার মধ্যে মজা আছে না? মানুষ তো গাছ না। সে কতক্ষণ এইভাবে থাকে কী করে এইটাই আমরা দেখব।
তুই পাগলি আছস।
আমরা সবাই পাগল। একেকজন একেকরকম পাগল। তুমি হচ্ছ সেয়ানী পাগল।
হাজেরা বিবি এখন রশিদের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী হয়েছেন। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, ঘটনা তো সত্য। এই হারামজাদা ঝিম ধইরা আছে কী জন্যে?
হে চায় কী? ডাক দিয়া জিগা।
ডেকে জিজ্ঞেস করলে তো দেখার মজাটা থাকবে না। দাদি, এখন পুকুরঘাটের দিকে তাকাও। দেখো একজন বই পড়ছে। তার নাম হাসান রাজা।
হাজেরা বিবি বললেন, এই হারামজাদা এখনো আছে?
নাদিয়া বলল, সবাইকে হারামজাদা বলছ কেন?
হাজেরা বিবি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, যে হারামজাদা তারে হারামজাদা বলব না। মহারাজা বলব? নিজের বাপরে গুলি কইরা মারছে। বাপ নামাজে বসছে, তখন দু’নলা বন্দুক দিয়া গুলি দিচ্ছে। ঠাস ঠাস।
নাদিয়া বলল, এইসব কী বলছ দাদি?
হাজেরা বিবি বললেন, বাতাসে ভাইস্যা যা কানে আসে তা-ই বলি। আগ বাড়ায়া কেউ আমারে কিছু বলে না। রশিদ হারামজাদাটা গেল কই?
নাদিয়া বলল, আমরা যখন দিঘির ঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন সে চলে গেছে।
গেছে কোনদিকে?
সেটা তো আমি জানি না দাদি।
হাজেরা বিবি বললেন, জানা দরকার।
কেন জানা দরকার?
এতক্ষণ খাম্বার মতো খাড়ায়া ছিল, ফুড়ুৎ কইরা চইলা গেল। কই গেল জানা দরকার না?
নাদিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, হাসান রাজা নামের এই যুবক নিজের বাবাকে গুলি করে মেরেছে এটা কি সত্য?
তোর বাপরে জিজ্ঞাস কইরা জান, সত্য না মিথ্যা। তোর বাপু অবশ্য মিছা কথার বাদশা। সমানে মিছা বলবে। তার চউক্ষের দিকে তাকায়া থাকবি মিছা বলার সময় তোর বাপের চউখ পিটপিট করে। আচ্ছা রশিদ হারামজাদা তো আর বাইর হইতেছে না। চিন্তার বিষয় হইল।