প্রণব বড় একটা জুলচৌকিতে আসন করে বসেছেন। তার সামনে পানের বাটা। নানান পদের মসলা ছোট ছোট কৌটায় ভরা। তিনি কৌটার মুখ খুলে মসলার গন্ধ শুকে শুকে দেখছেন।
হাবীব বললেন, মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে তোমার ধারণা কী প্রণব?
প্রণব বললেন, সাধুপুরুষ।
হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, সাধুপুরুষ রাজনীতি করে না।
প্রণব বললেন, তাও ঠিক।
হাবীব বললেন, মানুষটার কাজকর্ম চিন্তাভাবনা কিছুই বুঝি না। আয়ুব খানের পক্ষের লোক ছিল—এখন উল্টাগীত শুরু করেছে। গদি ছাড়তে বলতেছে। তার হিসাব কিছুই বুঝতেছি না।
প্রণব বললেন, সাধুপ্রকৃতির মানুষের হিসাব বুঝতে সাধুমানুষ লাগে। সবাই পারে না। বগুড়ার মোহম্মদ আলির কথা চিন্তা করেন। সবাই তার হিসাব জানে। কারণ সে চোরপ্রকৃতির।
হাবীব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, চোরকৃতির বললা কী জন্যে?
প্রণব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, পূর্বপাকিস্তানের এমএলএ যারা তারা সবাই শপথ করে গেল সংসদে তারা পূর্বপাকিস্তানের দাবিদাওয়া তুলবে। বগুড়ার মোহম্মদ আলি নিজেও শপথ নিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছেই আয়ুব খানের সঙ্গে আঁতাত করে বসলেন। এই দিকে আমি মোনায়েম খান সাহেবকে ধন্যবাদ দিব। উনি আগে কোনো শপথ করেন নাই। স্যার, পান খাবেন?
হাবীব বললেন, দাও খাই। জর্দা ছাড়া। জর্দা সহ্য হয় না। মাথা ঘুরে।
প্রণব বললেন, সামান্য দেই? জর্দা ছাড়া পান আর বোতাম ছাড়া শার্ট একই। বোয়াম ছাড়া শার্টে নিজেকে নেংটা লাগে। জর্দা ছাড়া পানও নেংটা পান।
দেশের গতিক কী বুঝতেছ?
কিছু বুঝতেছি না।
পশ্চিম পাকিস্তানে তো ভালো হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভুট্টো সাহেবকে ঢুকায়েছে জেলে। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানও জেলে। এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ঝামেলা সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কিছু পারে না। দেশ কিছুদিন ঝামেলা ছাড়া চলবে।
প্ৰণব বললেন, অবশ্যই।
হাবীব বললেন, একজন ঝামেলাওয়ালা, আরেকজন সুনশনওয়ালা। কথায় কথায় অনশন। কার কথা বললাম বুঝেছ?
না।
হাবীব রশিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ফরিদকে ডাক দিয়া আনো। জটিল কিছু কথা তার সঙ্গে আছে। কথার সময় তুমি থাকবা না। বাতাসের প্রয়োজন নাই। আজ আবহাওয়া শীতল।
হাবীব জর্দা দেওয়া পান চিবুচ্ছেন। সামান্য মাথা ঘুরছে, তবে খারাপ লাগছে। ফরিদ এসে বেতের মোড়ায় বসেছে, তাকে চিন্তিত এবং ভীত মনে হচ্ছে। প্রণব তার জায়গাতেই আছেন। হাবীব ফরিদের দিকে না তাকিয়ে বললেন, কেমন আছ ফরিদ?
ফরিদ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো আছি।
সংসার কেমন চলতেছে?
ভালো।
ফরিদ, তোমার বুদ্ধি কেমন?
ফরিদ চমকে তাকাল। কী বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ বুদ্ধির প্রসঙ্গ কেন চলে এসেছে কে জানে। তার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। পানি খাবার জন্যে উঠে যাওয়া সম্ভব না।
হাবীব বললেন, তোমার বুদ্ধির একটা পরীক্ষা নিব বলে তোমাকে ডেকেছি। আজকের ইত্তেফাকে একটা খবর ছাপা হয়েছে—গরুর হাতে গরুচোরের মৃত্যু। খবরটা শব্দ কইরা পড়ো আমি শুনি! খবরটা তৃতীয় পাতায়।
ফরিদ খবরের কাগজ হাতে নিল। তার হাত সামান্য কাঁপছে। সে সব পাতাই খুঁজে পাচ্ছে, তৃতীয় পাতাটা খুঁজে পাচ্ছে না। প্রণব বের করে দিলেন। ফরিদ পড়তে শুরু করল।
গরুর হাতে গরুচোরের মৃত্যু।
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
ধর্মপাশা অঞ্চলের কুখ্যাত গরুচোর আবুল কাশেমের মৃত্যু হইয়াছে গরুর হাতে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, আবুল কাশেম জনৈক গৃহস্থের বাড়ি হইতে একটি বলশালী ষাড় চুরি করিয়া হাওরের জনশূন্য প্রান্তর দিয়া দ্রুত পালাইতেছিল। এর মধ্যে তার ধূমপানের নেশা জাগ্রত হয়। সে ষাড়ের দড়িটি নিজের কোমরে বাঁধিয়া একটি বিড়ি ধরায়। দেয়াশলাইয়ের আগুন দেখিয়া গরু চমকাইয়া ছুটিতে শুরু করে। এবং গৃহস্থের বাটিতে উপস্থিত হয়। দেখা যায় দড়ির একপ্রান্তে গরুচোরের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। কুখ্যাত গরুচোরের মৃত্যুতে অত্র অঞ্চলে
স্বস্তির সুবাতাস বহিতেছে। ফরিদ খবর পড়া শেষ করে চিন্তিত চোখে হাবীবের দিকে তাকাল। হাবীব বললেন, খবরটায় একটা বড় ভুল আছে। ভুলটা কী?
ফরিদ বলল, বলতে পারব না স্যার।
হাবীব প্রণবের দিকে তাকালেন। প্রণব মাথা চুলকে বললেন, আমিও পারব না।
হাবীব বললেন, দেয়াশলাইয়ের আগুন দেখে ভয় পেয়ে গরু দৌড়াতে শুরু করল। এই খবরটা নিজস্ব সংবাদদাতাকে কে দিল? চোর দিতে পারবে না, সে মৃত। তাহলে খবরটা দিতে পারে গরু নিজে। তার পক্ষে কি খবরটা দেওয়া সম্ভব?
এখন ভুল বুঝতে পেরেছ?
ফরিদ হা-সূচক মাথা নাড়ল। হাবীব বললেন, ফরিদ, তোমাকে এই ভুলের কথা বলার পেছনে একটা কারণ আছে। যাতে তুমি আমার বিচার বিবেচনায় আস্থা রাখতে পারো। যাতে বুঝতে পারে যে, আমার সিদ্ধান্তে ভুল থাকে না। আমি তোমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি কিছুদিন জেল খাটবা। রাজি আছ?
ফরিদ বলল, আপনি যা বলবেন তা-ই করব।
হাবীব বলেন, অনোর অপরাধে জেল খাট। ভাতে তোমার লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হবে না। ব্রহ্মপুত্র নদীর দক্ষিণ দিকে কুড়ি বিঘা ধানি জমি পাইবা। তার সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার টাকা। রাজি আছ?
ফরিদ বলল, আপনি যা করতে বলবেন আমি করব। টাকা বা জমি লাগবে। আপনি একটা কাজ করতে বলতেছেন এ-ই যথেষ্ট।
হাবীব বললেন, টাকা-জমি অবশ্যই লাগবে। তুমি বিবাহ করেছ। তোমার সংসার হয়েছে। জেল থেকে বের হয়ে তুমি রাজার হালে জীবন কাটাবে। আশ্রিত জীবন কাটাতে হবে না।