নাদিয়া বলল, আমার ধারণা এই বাড়ির সবচেয়ে ভালোমানুষ পাংখাপুলার রশিদ।
লাইলী বললেন, ভালোমানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিস কেন?
কোনো কারণ নেই, এম্নি। আচ্ছা মা, এই বাড়ির সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটা কে?
লাইলী বললেন, তুই নিজে।
নাদিয়া বলল, হয়েছে। মা, আমি তোমার কাছে আমার বুদ্ধির একটা নমুনা দিচ্ছি। হাসান রাজা চৌধুরী নামের যে ছেলেটার সঙ্গে আমার সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে, বাবা তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। ঠিক বলেছি?
লাইলী কিছু বললেন না। চাঁদ উঠেছে। তিনি দিঘির জলে চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মা, ছোটমামার নাম ভুলে গিয়েছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল। এখন মনে পড়েছে। একই সঙ্গে অন্য একটা রহস্য ভেদ করেছি।
কী রহস্য?
সবুজ শাড়ি রহস্য। তুমি তোমার অতি পছন্দের সবুজ শাড়ি পরো না তার কারণ ছোটমামা।
ওই প্রসঙ্গ থাক।
আচ্ছা থাক। আচ্ছা মা ছোটমামার একটা ত্রুটির কথা বলে। ত্রুটিশূন্য একজন মানুষের কথা ভাবতে খারাপ লাগে।
ওর কোনো ত্রুটি ছিল না।
মা ছিল। উনি জানতেন তাঁর কোনো ত্রুটি নেই। এ কারণে তাঁর অহঙ্কার ছিল। অহঙ্কার বড় ধরনের ত্রুটি। ঠিক না মা?
হ্যাঁ ঠিক। মা তোমার কি মনে হয়—আমি অহঙ্কারী।
লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই অহঙ্কারী না। তুই তোর ছোটমামার মতো ত্রুটিশূন্য মানুষ।
মা। থ্যাংক য়ু।
হাজেরা বিবির সামনে মলিনা দাঁড়িয়ে আছে। কেঁদে সে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখের কাজল গালে লেপ্টে গেছে। হাজেরা বিবি তার কান্নাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি নিজমনে পান ছেঁচে যাচ্ছেন।
তোরে বিদায় দিয়া দিচ্ছে?
জে।
বিদায় দিল কে?
প্রণব স্যার।
হেন্দুটা তো বড় ত্যাক্ত করে। এইজন্যেই হেন্দুজাত খারাপ।
মলিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কাইল সকাল আটটার আগে বাড়ি ছাইড়া যাইতে বলছেন। কী অপরাধ করলাম কিছুই জানি না। এককথায় বিদায়।
চইলা যাইতে বললে চইলা যাবি। ঘরে দৈ খাকলে দৈ খায়া যাবি। দধি যাত্রা শুভ।
দাদি, কী কন আপনি! আমি চইলা যাব?
হাজেরা বিবি বিরক্ত হয়ে বললেন, তোরে বিদায় দিছে, তুই যাবি না তো কী করবি? ঘরে বইসা ডিম পাড়বি?
মলিনা বলল, বড় সাব ঘটনা এখনো শুনে নাই। বড় সাব শুনলে ব্যবস্থা নিতেন।
কী ব্যবস্থা নিতেন?
আমারে বিদায় করতেন না।
হাজেরা বিবি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার ছেলে তোর বিদায় করত না কোন কারণে? তুই কি তার সাথে হাঙ্গা বসছস? দুপুর রাইতে ঠোটে রঙ মাখছস। তুই কি নটি বেটি? বদমাগি! দূর হ সামনে থাইকা।
হাজেরা বিবি পান ছেঁচায় মন দিলেন।
খিচুড়ি মুখে দিয়ে প্রণবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রচণ্ড ঝাল। মন্ত্রপাঠে ভুল হয়নি। শুদ্ধ শরীরে বেঁধেছেন। রান্নার সময় হাঁড়িতে কি কোনো মুসলমানের ছায়া পড়েছে? গুরু বলে দিয়েছিলেন, নির্জন স্থানে রান্না করতে হবে। যেন হাঁড়িতে কোনো বিধর্মীর এবং কুকুরের ছায়া না পড়ে। অন্য জীবজন্তুর ছায়া পড়লে অসুবিধা নাই।
কষ্ট করে এই খিচুড়ি খাওয়ার অর্থ হয় না। প্রণব উঠে পড়লেন। রাতে এক গ্লাস দুধ খাবেন।
অতিথঘরের বারান্দায় হাসান রাজা বসে আছে। মূর্তির ভঙ্গিতে বসা। কোনো নড়াচড়া নেই। এই যুবক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে। প্রণবের হরিদ্বারের গুরুত্বও এই ক্ষমতা ছিল। তিনি চোখের পলকও ফেলতেন না। এই যুবক নিশ্চয়ই পলক ফেলে। তারপরেও পরীক্ষা করা দরকার।
হাসান প্রণবের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। প্রণব সামান্য বিরক্ত হলেন। একজন বয়স্ক মানুষকে সম্মান দেখাতে হয়। তাকে ‘আদাব’ বললে দোষ হতো না।
প্রণব বললেন, ভালো আছেন?
হুঁ।
রাতের খাওয়া হয়েছে?
না।
খাওয়া আসে নাই?
এসেছে, পরে খাব।
প্রণব বললেন, পরে কেন খাবেন? গরম গরম খেয়ে নেন।
হাসান বলল, ঠান্ডা খাবার খেতে আমার অসুবিধা হয় না।
প্রণব বললেন, আমি আবার ঠান্ডা খেতে পারি না।
হাসান বলল, একেক মানুষ একেক রকম।
প্রণব বসলেন হাসানের পাশের চেয়ারে। মুখোমুখি বসতে পারলে ভালো হতো। চোখের পলক ফেলার ব্যাপারটা ধরা যেত। বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে, এটাও একটা সমস্যা।
প্রণব বললেন, নাদিয়া মা’র সঙ্গে আলাপ করছেন দেখলাম। কী নিয়ে আলাপ।
হাসান বলল, তেমন কিছু না।
প্রণব বললেন, নাদিয়া অতি গুণের মেয়ে। মাথায় সামান্য ছিট আছে। গুণের সব মানুষই কিছুটা ছিটগ্রস্ত হয়।
হাসান কিছুই বলল না। চুপ করে রইল। প্রণব আশা করেছিলেন হাসান জানতে চাইবে কী ধরনের ছিট। কেউ কিছু জানতে চাইলে সে বিষয়ে বলা যায়। নিজ থেকে বলা এক সমস্যা। প্রণব বললেন, কী ধরনের ছিটগ্রস্ত সেটা বলি। নাদিয়া মা আমাকে বলল, প্রণব কাকা! জোনাকির আঁকে কয়টা করে জোনাকি থাকে আমাকে শুনে বলবেন। উড়ন্ত জোনাকি গুনা কি সম্ভব?
হাসান এখনো নিশ্চুপ। প্রণব বললেন, মলিনা বলে যে একটা মেয়ে আছে, অল্পবয়স্ক, সুন্দরমতো গোল মুখ। তার চাকরি নট হয়েছে। আগামীকাল ভোর আটটার আগে তাকে চলে যেতে হবে। মনে হয় কোনো বড় ধরনের ভুলত্রুটি করেছে। আপনার সঙ্গে কি কিছু করেছে?
হাসান বলল, না।
নীলমণি লতাটার পাশে জোনাকির একটা ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। হাসান ঝাঁকের জোনাকি মনে মনে গুনছে। সতেরোটা জোনাকি হিসাবে পাওয়া গেল।
হাবীব বৈঠকথানার ইজিচেয়ারে
হাবীব বৈঠকথানার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। রশিদ বড় তালপাতার পাখায় তাকে হাওয়া করছে। আজ ছুটির দিন। কোর্ট বন্ধ। হাবীব আয়োজন করে খবরের কাগজ পড়তে বসেছেন। ছুটির দিনে তিনি মন দিয়ে কাগজ পড়েন। কোনো খবর বাদ যায় না। কিছু কিছু খবর নিয়ে প্রণবের সঙ্গে আলাপ করেন।