হাবীব মার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ হাসি হাসি করে বললেন, ডাকেন কেন?
হাজেরা বিবি বললেন, তুই আছিস কেমন?
ভালো আছি। আর কিছু বলবেন? মক্কেল বসে আছে।
হাজেরা বিবি বললেন, আঁটা মেরে মক্কেল বিদায় কর। তোর সাথে আমার জরুরি কথা।
বলেন, শুনি আপনার জরুরি কথা।
বাড়িতে কী ঘটেছে?
হাবীব বললেন, কিছুই ঘটে নাই।
হাজেরা বললেন, শুনলাম সন্ধ্যাকালে বাড়িতে এক ঘটনা ঘটবে।
কী ঘটনা ঘটবে?
বাড়িতে কাজী সাহেব আসতেছে। বিবাহ পড়াবে?
হাবীব মার খাটের পাশে বসতে বসতে বললেন, সবই তো জানেন। আপনাকে বলেছে কে? যে আপনের কানে কথাটা তুলেছে তার নামটা বলবেন? কে বলেছে?
নাম বললে তুই কী করবি? ফৌজদারি মামলা করবি? তোর বউ লাইলী বলেছে। এখন যা মামলা কর। বৌরে জেলে ঢুকা। এই বাড়ির ভাত তার রুচে না। জেলের ভাত খাইয়া মোটাতাজা হইয়া ফিরুক।
হাবীব বললেন, লাইলী আপনাকে কতটুকু বলেছে সেটা শুনি।
হাজেরা বিবি বললেন, কী বলেছে মনে নাই। সন্ধ্যাকালে কাজী আসবে, বিবাহ পড়াবে—এইটা মনে আছে। ঘটনা কি সত্য?
হ্যাঁ সত্য। আর কিছু জানতে চান?
জানতে চাই। ইয়াদ আসতেছে না। আচ্ছা তুই যা। মক্কেলের সাথে দরবার কর।
হাবীব সরাসরি তার চেম্বারে গেলেন না। তিনি গেলেন রান্নাঘরে। লাইলীকে কঠিন কিছু কথা বলা দরকার। বারবার বলে দিয়েছিলেন, বিয়ের এই ঘটনা কেউ যেন না জানে।
রান্নাঘরে লাইলী মাছ কাটা তদারক করছেন। প্রকাণ্ড এক কাতল মাছ তিনজনে ধরেও সুবিধা করা যাচ্ছে না। হাবীব খানের মক্কেলের ভাটি অঞ্চলে জলমহাল আছে। সেখানকার মাছ। বিশাল টাটকা মাছ দেখাতেও আনন্দ। লাইলী মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে বললেন, এক টুকরা মাছ কি ভেজে দিব? খাবেন?
দাও। আরেকটা কথা, ফরিদের বিবাহ বিষয়ে মা’কে তুমি কিছু বলেছ?
বলেছি।
উনাকে বলতে নিষেধ করেছিলাম না? কেন বললা?
আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন বলেই বলেছি। শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করবেন, আর আমি মিথ্যা বলব?
হাবীব বললেন, উনার কাছে এখন সত্য-মিথ্যা সবই সমান।
লাইলী বললেন, উনার কাছে সমান কিন্তু আমার কাছে সমান না। আমার কাছে মিথ্যা, মিথ্যাই।
হাবীব রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাহাসে যাবার এটা উপযুক্ত সময় না। রান্নাঘরে মাছ কাটাকাটি হচ্ছে। সবাই কান পেতে আছে। কামলাশ্রেণীর মানুষের প্রধান কাজই হলো, ঝাকি জালের মতো কান ফেলা। হাবীব চেম্বারের দিকে রওনা হলেন।
চেম্বারে মুহুরি প্রণব বাবু ছাড়া মক্কেলরা কেউ নাই। তারা জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছে। খুনের মামলায় যে পড়ে সে এবং তার আত্মীয়স্বজনরা কখনো জুম্মার নামাজ মিস দেয় না।
প্রণব মুখে পান দিতে দিতে বললেন, ভালো পার্টি। এরকম পার্টি বৎসরে একটা পেলেও চলে। জলমহাল আছে তিনটা। বিলাত থেকে ব্যারিস্টার আনতে কত খরচ লাগবে জানতে চাইল।
তুমি কী বললা?
আমি বললাম, বিলাতের খবর রাখি না। দেশের খবর রাখি। তখন সে বলল, পূর্বপাকিস্তানের সবচেয়ে বড় উকিল কে?
আমি বললাম, আপনি তো খোঁজখবর নিয়া তার কাছেই আসছেন। আবার ‘জিগান’ কোন কারণে? মনে সন্দেহ থাকলে কোর্ট কাচারিতে ঘুরেন। ঘুরে খবর নেন। তারপরে আসেন। আমরা তো আপনারে দাওয়াতের কার্ড ছাপায়া আনি নাই। তখন চুপ করে গেল।
হাবীব বললেন, প্রণব, তোমার একটাই দোষ। কথা বেশি বলে। যে কথা বেশি বলে তার গুরুত্ব থাকে না। কথা হলো দুধের মতো। অধিক কথায় দুধ পাতলা হয়ে যায়।
প্রণব বললেন, কথা কম বলার চেষ্টা নিতেছি। পারতেছি না। শুনেছি তালের রস খেলে কথা বলা কমে। এই ভাদ্র মাসে তাল পাকলে একটা চেষ্টা নিব।
হাবীব বললেন, কাজী আসবে কখন?
প্রণব বললেন, রাত দশটার পর আসতে বলেছি। চুপিচুপি কর্ম সমাধা হবে। বিয়ে অধিক রাতে হওয়াই ভালো। আপনাদের তো সুবিধা আছে, লগ্নের কারবার নাই! যখন ইচ্ছা তখন কবুল কবুল কবুল।
হাবীব বললেন, ফরিদকে চোখে চোখে রাখতে বলেছিলাম, রেখেছ? পালিয়ে যায়।
তার ঘরের দরজার সামনে সামছুকে বসায়ে রেখেছি। পালায় যাবার পথ নাই! আর পালাবে বলে মনে হয় না। ঝিম ধরে বসে আছে। হারামজাদা।
গালাগালি করবে না।
প্রণব বললেন, কেন করব না স্যার? সে হারামজাদা না তো কে হারামজাদা। আরে তুই একটা মেয়ের পেট বাধায়েছিস, এখন তুই বিয়ে করবি না? তুই বিয়ে না করলে তার বাপরে দিয়ে বিয়ে করাব।
কথা কম বলো প্রণব।
চেষ্টা করতেছি স্যার। রোজ ভোরে সূর্যপ্রণাম করে ভগবানকে বলি, ভগবান! দয়া করো। জবান কমাও।
হাবীব বললেন, আমাকে এক পিস ভাজা মাছ দিতে বলেছিলাম। কোনো খোঁজ নাই। তোমার বৌদিকে বললা মাছ লাগবে না।
হাবীবের কথা শেষ হবার আগেই বড় কাসার প্লেটে এক টুকরা মাছ চলে এল। বিশাল টুকরা। তাকিয়ে দেখতেও আনন্দ। মাছের সঙ্গে চামচ আছে। হাবীব হাত দিয়ে মাছ ভেঙে মুখে দিলেন। খাদ্যদ্রব্য হাত দিয়ে স্পর্শ করাতেও আনন্দ আছে। সাহেবরা কাটাচামচ দিয়ে খায়। খাদ্য হাত দিয়ে ছোয়ার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত।
মাছে লবণের পরিমাণ ঠিক আছে। এটা আনন্দের ব্যাপার। চায়ে চিনি এবং মাছে লবণ একই। সামান্য বেশকম হলে মুখে দেওয়া যায় না।
হাবীব বললেন, খুনটা করেছে কে?
নাম জহির। একুশ-বাইশ বছর বয়স। ঘরে লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল। সেটা দিয়ে নিজের আপন মামাকে গুলি করেছে। পুলিশ এখনো চার্জশিট দেয় নাই। অনেক টাকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে চার্জশিট দু’এক দিনের মধ্যে দিবে।