কী পরীক্ষা নিয়েছেন?
হাবীব বললেন, মলিনা নামে তোমার যে দাসী আছে, গভীর রাতে তাকে ছেলের কাছে নগ্ন অবস্থায় পাঠায়েছিলাম। ছেলে তাকে ধমক দিয়ে বিদায় করেছে। এবং ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করে নাই।
লাইলী হতভম্ব গলায় বললেন, আপনার মতো মানুষ একজন দাসীর সঙ্গে পরামর্শ করে এমন নোংরা কাজ করে?
হাবীব বললেন, মলিনার সঙ্গে পরামর্শ আমি করি নাই। প্রণব করেছে।
লাইলী বললেন, কথা একই। প্রণব বাবু আপনার হয়েই কথা বলেছে। কত বড় অন্যায় কাজ আপনি করেছেন তা বুঝতে পেরেছেন?
হাবীব বললেন, তুমি বুঝতে পেরেছ এই যথেষ্ট। আমার বুঝার প্রয়োজন। নাই। একসঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার কথা শেষ। এখন যাও বাগান থেকে মেয়েকে নিয়ে আসো। আরেক কথা, আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করবা না। তুমি আদালত না।
লাইলী উঠে দাঁড়ালেন। হাবীব এশার নামাজের প্রস্তুতি নিলেন। মাগরেবের নামাজ শেষ করে এশা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকা এবং এশার নামাজ আদায় করা একটা উত্তম সুন্নত।
বাগানে ঢোকার মুখে প্রণবের সঙ্গে লাইলীর দেখা হলো। প্রণব রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খিচুড়ি বসাবেন। কাঁচামরিচ খিচুড়ি। এক মুঠ চাল, এক মুঠ ডাল, দশটা কাঁচামরিচ, এক চামচ ঘি দিয়ে অল্প আঁচে রান্না হবে। আঁচের বেকম হলেই খিচুড়ির ঝাল ঠিক থাকবে না।
লাইলী ডাকলেন, প্রণব বাবু, একটু শুনে যান।
প্রণব ছুটে গেলেন। মাথা নিচু করে জোড়হাতে নমস্কার বললেন। লাইলী বললেন, আমার বাপের বাড়ির যে দাসী এ বাড়িতে থাকে, মলিনা নাম, তাকে আগামীকাল ভোরবেলায় টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় করে দেবেন।
প্রণব বললেন, অবশ্যই। সকাল আটটার পর তাকে আর এ বাড়িতে দেখবেন না।
রান্না বসিয়েছেন? কী রাঁধছেন?
মরিচ-খিচুড়ি। হরিদ্বারের এক সাধুবাবার কাছ থেকে এই রান্না শিখেছি। ঠিকমতো বাঁধতে পারলে অমৃত। মন্ত্র পাঠ করতে করতে রাঁধতে হয়।
কী মন্ত্র?
প্রণব হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পাঠ করলেন
গন্ধপুষ্পে ও গনপতয়ে নমঃ
গন্ধপুষ্পে ওঁ নারায়ণায় নমঃ
গন্ধপুষ্পে ও শিবাদি পঞ্চ দেবতাভ্য নমঃ
মন্ত্রপাঠ শেষ করে প্রণব লজ্জিত গলায় বললেন, এই খিচুড়ি অন্য কাউকে খাওয়ানো গুরুর নিষেধ, নয়তো আপনাকে একদিন বেঁধে খাওয়াতাম।
লাইলী বললেন, আপনি একজন সাধুপ্রকৃতির মানুষ। সাধুপ্রকৃতির মানুষ হয়ে বড় বড় অন্যায়গুলি কীভাবে করেন?
প্রণব শান্ত গলায় বললেন, ন্যায়-অন্যায় সবই ভগবান করান। ভগবানের অনুমতি ছাড়া কেউ ন্যায়ও করতে পারে না, অন্যায়ও করতে পারে না।
লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বাগানের দিকে রওনা হলেন। কদমগাছের নিচে নাদিয়া বসে আছে। তার পরনের শাড়ি সাদা দূর থেকে সাদা রঙ চোখে পড়ছে। কুমারী মেয়েদের সাদা শাড়ি নিষিদ্ধ, কিন্তু নাদিয়ার প্রিয় রঙ সাদা।
নাদিয়া বলল, আমাকে নিতে তুমি আসবে আমি জানতাম। আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
লাইলী মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, মশার কামড় খাচ্ছিস?
নাদিয়া বলল, মশা কানের কাছে গুনগুন করছে কিন্তু কামড়াচ্ছে না। মা দেখো, জোনাকির ঝাঁক। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। প্রকৃতিতে কত অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস আছে, তাই না মা? একেকটা ঝাঁকে কতগুলি করে জোনাকি থাকে গোনার চেষ্টা করছি, পারছি না।
লাইলী বললেন, ঘরে চল। এতক্ষণ ধরে বাগানে বসে আছিস, তোর বাবা রাগ করছে।
নাদিয়া বলল, করুক একটু রাগ। মা শোনো, আজ সন্ধ্যাবেলা এক যুবকের সঙ্গে আমার দেখা। গ্রিক দেবতাদের মতো তার রূপ।
গ্রিক দেবতা তুই দেখেছিস?
ছবিতে দেখেছি।
লাইলী বলল, দেবতার সঙ্গে কী কথা হলো?
নাদিয়া বলল, আমি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার নিজের আলাদা করা জায়গায় বসেছিল। দেখে হঠাৎ রাগ উঠে গেল।
লাইলী বললেন, আমিও তো বসেছি। আমাকে দেখে রাগ লাগছে না?
লাগছে। তবে বেশি লাগছে না। একা একা এখানে আমি ছাড়া কেউ বসতে পারবে না। আমার সঙ্গে পারবে।
লাইলী বললেন, তোর বাবা তোর বিয়ে দিতে চাচ্ছে।
নাদিয়া হালকা গলায় বলল, দিতে চাইলে দিবে। গাভর্তি গয়না পরে বিয়ে করব।
তোর নিজের পছন্দের কেউ আছে?
না। আর যদি কেউ থাকেও তার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিবে না। আমার বিয়ে করতে হবে বাবার পছন্দের কাউকে।
লাইলী বললেন, চল ঘরে যাই।
নাদিয়া বলল, আরেকটু বসি। চাঁদ দেখে যাই। এখনই চাঁদ উঠবে।
লাইলী বললেন, ঘন জঙ্গলে বসে আছিস, চাঁদ দেখবি কীভাবে?
নাদিয়া বলল, দিঘির পানিতে চাঁদের ছায়া পড়বে। সেটা দেখব। আচ্ছা মা, দাদি যেসব গল্প করে তার সবই কি মিথ্যা?
লাইলী বললেন, বেশির ভাগই মিথ্যা। উনার মাথা পুরোপুরি গেছে। এখন যা মনে আসে বলেন।
নাদিয়া বলল, আমার নিজের কী ধারণা জানো মা? দাদির মাথা ঠিক আছে। তিনি ভাব করেন ঠিক নেই। এতে তার কিছু সুবিধা হয়। তিনি মিথ্যা কথার মাঝখানে কঠিন কঠিন সত্য কথা বলতে পারেন।
লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হতে পারে।
নাদিয়া বলল, এই বাড়িতে তুমি ছাড়া সবচেয়ে ভালো মানুষ কে বলে তোমার ধারণী?
লাইলী বললেন, জানি না। প্রণব বাবু হতে পারেন।
নাদিয়া বলল, প্রণব কাকা না মা। উনার আচার-আচরণে ভালোমানুষ ভঙ্গি আছে। এই পর্যন্তই। বাবা যদি প্রণব কাকাকে ডেকে বলে, অমুককে খুন করো। প্রণব কাকা নিজে খুনটা করবে না, অন্যকে দিয়ে ঠিকই করাবে।
লাইলী বললেন, হতে পারে।