সতেরো দিন।
সতেরো দিনে কেউ আপনাকে বলেনি যে কদমগাছের নিচে বসা নিষেধ।
বলে নাই। নিষেধ কেন?
নাদিয়া বল, আমি নিষেধ করেছি এইজন্যে নিষেধ। এই গাছটা আমার। এখানে আমি একা বসি।
হাসান বলল, আর বসব না।
নাদিয়া বলল, বিকেলে বই পড়ার জন্যে এই বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। আপনি পুকুরঘাটে বসতে পারেন।
হাসান বলল, আমি বেশির ভাগ সময় সেখানেই বসি।
নাদিয়া বলল, চা খাবেন? আপনাকে চা দিতে বলব? আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি তো, এইজন্যে চায়ের কথা বলে কাটান দেওয়ার চেষ্টা করছি।
হাসান বলল, আমি চা খাব না।
নাদিয়া বলল, আমাকে কি আপনি চিনেছেন?
আপনি এই বাড়ির মেয়ে। আপনার নাম নাদিয়া।
নাদিয়া বলল, আমার তিনটা নাম। একটা নাম তোজল্লী, আমার দাদি রেখেছেন। বাবা-মা নাম দিয়েছেন নাদিয়া। ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা আমাকে ডাকে দিয়া। তারা না বাদ দিয়েছে। আপনার সঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলেছি, এখন চলে যান। আমি একা একা বসে চা খাব। ভালো কথা, আপনি গত সতেরো দিন ধরে কোথায় অর্থাৎ কোন ঘরে থাকেন?
হাসান আঙুল উঁচিয়ে দেখাল।
নাদিয়া বলল, অতিথঘরে থাকেন? ভূত দেখেছেন? অতিথঘরে ভূত থাকে। বেদানা নামের একটা মেয়ে ওই ঘরে শাড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছিল। নিশিরাতে হঠাৎ হঠাৎ তাকে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে। আপনি দেখেননি?
না।
ঘুমিয়ে রাত পার করলে কীভাবে দেখবেন? সারা রাত জেগে থাকবেন, তাহলে দেখতে পাবেন। আচ্ছা এখন যান। কী আশ্চর্য! বইখাতা সব ফেলে চলে যাচ্ছেন। নিয়ে যান।
নাদিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিতে খারাপ লাগছে না। অন্ধকার নামছে। দিঘির পানি শুধু চকচক করছে। আর সবই অন্ধকার। মাগরেবের আযান হচ্ছে। নাদিয়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিল। শুকনা পাতায় সড়সড় শব্দ হচ্ছে। সাপ যাচ্ছে মনে হয়। নাদিয়া পা উঠিয়ে বসল। সে হঠাৎ বিষণ্ণ বোধ করল। ছোটমামার নামটা সে মনে করতে পারছে না। তার এত প্রিয় একজন মানুষ, অথচ নাম মনে পড়ছে না। চোখের আড়ালে যে থাকে মানুষ তাকে দ্রুত ভুলে যায়। ব্রেইন নতুন স্মৃতি রাখার জন্য পুরনো স্মৃতি ধুয়ে ফেলে। হাসান নামে যে মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার স্মৃতি রাখার জন্যে ব্রেইন কিছু জায়গা করেছে। যে অংশে ছোটমামার স্মৃতি ছিল সেই অংশেই জায়গা করেছে কি না কে জানে।
মাগরেবের নামাজ শেষ করে হাবিব জায়নামাজের একটা কোনা ভাঙলেন। ভাজ করে রাখলেন। এখন এটা আর জায়নামাজ না। সাধারণ বসার আসন। এখন এখানে বসে সংসারি আলাপ-আলোচনা করা যায়। খাওয়াদাওয়া করা যায়।
লাইলী পানের বাটা হাতে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাবিব ইশারায় স্ত্রীকে ডাকলেন।
লাইলী বললেন, পান খাবেন? পান বানায়া দিব? হাবিব বললেন, পান খাব না। তুমি একটু বসো।
তিনি জায়নামাজ থেকে সামান্য সরলেন। ভদ্রতা করা। যেন বলা, আমার সঙ্গে জায়নামাজে বসো। যদিও সেরকম জায়গা নেই। লাইলী বসলেন তার সামনে। হাবীব বললেন, তোমার মেয়ে কোথায়?
লাইলী বললেন, বাগানে।
হাবীব বললেন, এই বাড়ির কিছু নিয়মকানুন আছে। সন্ধ্যাবেলা মেয়েছেলে বাগানে যাবে না।
লাইলী বললেন, নাদিয়া বাগানে ঘুরতে পছন্দ করে।
হাবীব বললেন, সব পছন্দের গুরুত্ব দিতে হয় না। আজ যদি তোমার মেয়ে বলে—এক হিন্দু শিক্ষককে আমার পছন্দ হয়েছে। তাকে বিবাহ করতে চাই। তুমি কি সেই মালাউনের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিবে?
লাইলী বললেন, নাদিয়া কি এমন কোনো কথা বলেছে?
হাবিব বললেন, বলে নাই। যদি বলে তুমি কী করবে? রাজি হবে?
না।
হাবীব বললেন, এখন কি বুঝতে পেরেছ সব পছন্দের গুরুত্ব দিতে হয় না?
বুঝতে পারছি।
কাউকে পাঠাও, মেয়েকে নিয়া আসুক।
লাইলী বললেন, আমি নিজেই যাব। নিয়া আসব। লাইলী উঠে দাঁড়াতে গেলেন। হাবীব বললেন, বসে, কথা শেষ হয় নাই।
লাইলী বসলেন! হাবীব বললেন, আমি তোমার মেয়ের বিবাহ দিতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
লাইলী বললেন, আপনার হাতে কি পাত্র আছে?
আছে। পাত্র এই বাড়িতেই ঘুরঘুর করতেছে।
বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে লাইলী বললেন, একজন খুনির সঙ্গে আপনি মেয়ের বিবাহ দিবেন?
হাবীব বললেন, হ্যাঁ দিব। খুন একটা দুর্ঘটনা। মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা বড় করে দেখতে হয় না। আত্মরক্ষার জন্যে কিংবা সম্মান রক্ষার জন্যে খুন করা জায়েজ আছে।
লাইলী কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। হাবীব বললেন, ওই ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পেছনে তিনটা কারণ আছে। প্রথম কারণ, জমিদার বংশ। ছেলে বাপের একমাত্র ওয়ারিশ। বিশাল বিষয়সম্পত্তি।
লাইলী বলেন, আপনার ধনসম্পদের কমতি নাই। ধনসম্পদের জন্য আপনার ‘লালচ’ থাকা ঠিক না।
হাবীব বললেন, আমার কথার মাঝখানে কথা বলবা না। স্বামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা শুরু করলে আদবের বরখেলাপ হয়। যাই হোক, ওই ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিবাহের দ্বিতীয় কারণ, ছেলেকে আমি মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করব। সে বাকি জীবন এই কারণে তোমার মেয়ের কেনা গোলাম হয়ে থাকবে।
লাইলী বললেন, একজন স্ত্রী স্বামী হিসাবে বন্ধু চায়। কেনা গোলাম চায় না।
হাবীব বললেন, আবারও আদবের বরখেলাপ করলা। যাই হোক, তৃতীয় কারণ শোনো। এই ছেলের চরিত্র ভালো। আমি পরীক্ষা নিয়েছি। পরীক্ষায় সে পাশ করেছে।