হাবীব বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার সাহায্য?
নাদিয়া বলল, ঠিক তোমার সাহায্য না। মোনায়েম চাচার সাহায্য। স্যরি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছেন। উনি হিন্দু তো, শেষ মুহূর্তে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে। মোনায়েম চাচাকে তুমি বলে দিলেই স্যারের সমস্যার সমাধান হবে।
হাবীব বললেন, কোনো হিন্দুকে স্কলারশিপ দিয়ে বাইরে পাঠানোর বিষয়ে আমার মত নেই। কারণ তারা Ph.D. শেষ করে কখনো পাকিস্তানে ফেরে না। হয় ওই দেশেই থেকে যায়, কিংবা ইন্ডিয়াতে চলে যায়।
নাদিয়া বলল, বিদ্যুত স্যার সেরকম মানুষ না।
তুই তার সঙ্গে কতটুক মিশেছিস যে বলে ফেললি তিনি সেরকম মানুষ না? সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও একজন মানুষ অন্য একজনকে বুঝতে পারে না। তোর মা কি আমাকে বুঝতে পারে? পারে না। আমিও তাকে বুঝতে পারি না।
নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচুগলায় বলল, বাবা, তুমি স্যারের কাজটা করে দেবে?
হাবীব দীর্ঘ সময় মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নাদিয়া মাথা নিচু করে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। হাবীব বললেন, তোর স্যারের কাজটা আমি কারে দেব।
নাদিয়া বলল, থ্যাংক য়ু বাবা!
হাবীব বললেন, তোর চোখে পানি কেন?
নাদিয়া বলল, তুমি স্যারের কাজটা করে দেবে না এই ভেবে দুঃখে আমার চোখে পানি এসেছে।
হাবীব বললেন, এত দুঃখ পাওয়ার কি কিছু আছে?
নাদিয়া জবাব দিল না।
হাবীব বললেন, আমি আরেক কাপ চা খাব। যা চা বানিয়ে আন।
হাজেরা বিবি ডাকছেন, হাবু হাবু! হাবুরে! ও হাবু!
হাবীব বিরক্ত মুখে উঠে গেলেন। মা’র ঘরে ঢুকলেন। হাজেরা বিবি পাশে বসার জন্যে ইশারা করলেন। তিনি পাশে বসলেন না।
হাজেরা বিবি বললেন, কাছে বোস। তোরে একটা গোপন কথা বলব।
হাবীব অনিচ্ছায় পাশে বসলেন।
হাজেরা বিবি বললেন, গোপন কথা বলার আগে তোরে একটা শিলুক ভাঙানি দেই। শিলুক ভাঙাইতে পারলে গোপন কথা বলব। না পারলে বলব না। শিলুকটা হইল—
কাটলে ‘লউ’ নাই
না কাটলে ‘লউ’
দিনেরবেলা লেংটা ঘুরে
মুক্তারপাড়ার বউ।
হাবু! ক’ দেখি জিনিসটা কী?
হাবীব কোনো জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঘুমুতে যাবার আগে রাতের শেষ খবর শুনে হাবীব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। আয়ুব খানকে নজরুল একাডেমী বিশাল সংবর্ধনা দিয়েছে। সেখানে আয়ুব খান বলেছেন একদিন দেশের সকল ভাষার সংমিশ্রণে একটি পাকিস্তানি ভাষা হবে।
হাবীবের মনে হলো জগাখিচুড়ি ভাষার দরকার কী? আয়ুব খান সবাইকে খুশি করতে চাচ্ছেন। সেটা সম্ভব না। সবাইকে খুশি রাখা যায় না। আয়ুব খান নরম ভাব ধরেছেন। কাউকে নরম দেখলে বাঙালি আক্কা গরম হয়ে যায়। সাপের মতো ফোঁসফাস শুরু করে।
আয়ুব খানকে নরম না হয়ে কঠিন গরম হতে হবে। তখনই সব সাপ গর্তে ঢুকবে। গর্তে আঁকাবাঁকা হয়ে ঢোকার বুদ্ধি নেই। গর্তে সোজা হয়ে ঢুকতে হয়। বাঙালি জাতির সোজা হয়ে গর্তে ঢোকার সময় হয়ে গেছে।
নাদিয়ার হাতে পুরনো দিনের বাহারি গ্লাস
নাদিয়ার হাতে পুরনো দিনের বাহারি গ্লাস। গ্লাসভর্তি চা। গ্লাস গরম হয়ে আছে। হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে না। নাদিয়া গ্লাসটা ধরেছে তার রুমাল দিয়ে। রুমালে সেন্টের গন্ধ। যতবার সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, ততবারই চায়ের গন্ধের সঙ্গে সেন্টের গন্ধ মিলে অন্যরকম সৌরভ তৈরি হচ্ছে। গন্ধটা ভালো লাগছে না, আবার খারাপও লাগছে না। নাদিয়া যাচ্ছে তার গাছের কাছে। গাছের নাম কদম।
নাদিয়ার ছোটমামা তাকে তার পঞ্চম জন্মদিনে এই গাছটা দিয়ে বলেছিলেন, নিজের হাতে এই গাছ লাগাবি। এখন তোর বয়স পাঁচ। যখন বয়স ষােল হবে, তখন এই গাছ মহীরুহের মতো বড় হয়ে যাবে। প্রতি বর্ষায় ফুল ফুটাবে। তখন তুই গাছের চারদিক বাধিয়ে দিবি। তুই আর তোর স্বামী গাছের বাধানেী পাড়ে বসে গল্প করবি। আমি দূর থেকে দেখব। নাদিয়ার মামা সেই বছরই যক্ষায় মারা যান। দূর থেকে কোনো দৃশ্যই তার দেখা হয়নি।
গাছ প্রসঙ্গে ছোটমামার কথা ফলেছে। কদমগাছ বিশাল হয়েছে। বর্ষার শুরুতে ফুলে ফুলে নিজেকে সে ঢেকে ফেলে। যেন শত শত সোনালি টেনিস বল নিয়ে কদমগাছ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, এসো আমার সঙ্গে বর্ষার খেলা খেলবে। নাদিয়া তার স্কলারশিপের টাকায় গাছের চারপাশ বাঁধিয়ে দিয়েছে এবং ছেলেমানুষের মতো বলেছে, এই গাছের বাঁধানো পাড়ে আমি ছাড়া কেউ বসবে না। নাদিয়ার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। এই গাছের বাঁধানো পাড়ে কেউ বসে না।
বাগানে ঢুকে নাদিয়া চমকে উঠল। তার গাছের বাঁধানো পাড়ে অচেনা একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার হাতে বই। সে বই পড়ছে। সন্ধ্যা হয় হয় সময়। আকাশ মেঘলা থাকায় আলো নেই বললেই হয়। এত অল্প আলোতে বই পড়া কষ্টের। মানুষটা চোখের কাছে বই ধরে এই কাজটা করছে। নাদিয়া প্রায় নিঃশব্দে লোকটার কাছাকাছি চলে এল। শান্ত গলায় বলল, আপনি কে?
মানুষটা হঠাৎ কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। তখন তার কোল থেকে পড়ল একটা চামড়ায় বাঁধানো খাতা এবং কলম।
আমি এই বাড়িতে থাকি।
নাদিয়া বলল, এই বাড়িতে অনেকেই থাকে। আপনি এই বাড়িতে থাকেন এটা কোনো পরিচয় হতে পারে না।
আমার নাম হাসান রাজা চৌধুরী।
আপনি কি বাবার নতুন কোনো কর্মচারী।
না।
কিছু মনে করবেন না। যতবারই আমি ছুটিতে বাড়িতে আসি, ততবারই বাবার নতুন কোনো কর্মচারী দেখি। এইজন্যেই বলেছি। আপনি কতদিন ধরে এখানে আছেন?