নাদিয়া বলল, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?
হাবীব বললেন, দেশটাকে ভালোবাসি বলে রেগে যাচ্ছি।
নাদিয়া বলল, বাবা, চা খাবে? আমি খুব ভালো চা বানানো শিখেছি। একটা কেরোসিনের চুলা কিনেছি। রুমে লুকানো আছে। হাউস টিউটররা যখন রাতের রোল কল শেষ করে চলে যান, তখন চা বানাই।
হাবীব বললেন, অনুমতি নাই এ ধরনের কাজ করা ঠিক না। একসময় ঘরে আগুন-টগুন লাগাবি। কেলেঙ্কারি হবে।
নাদিয়া হাসিমুখে বলল, একদিন আগুন লেগেছিল বাবা। বিছানার চাদরে আগুন ধরে গিয়েছিল। হাতের কাছে পানিভর্তি জগ থাকায় রক্ষা।
নাদিয়া চার কাপ চা বানিয়েছে। এক কাপ চা সে তার দাদিকে দিয়ে এসেছে। এক কাপ তার মা’কে। বাকি দুকাপ নিয়ে সে তার বাবার সঙ্গে বসেছে।
হাজেরা বিবি চায়ে চুমুক দিয়েই বললেন, নাতনি কী চা বানাইছে? চায়ের মধ্যে ‘পাদের গন্ধ।
লাইলী দুঃখিত গলায় বললেন, চা ভালো না লাগলে ফেলে দেন। আজেবাজে কথা কেন বলেন! তোজল্লী শুনলে মনে কষ্ট পাবে। নিজে আগ্রহ করে চা বানিয়েছে।
হাজেরা বিবি বললেন, পাদ দিয়া চা ক্যামনে বানাইছে এইটাই আমার জিজ্ঞাসা।
লাইলী হতাশ গলায় বললেন, চা খাওয়ার দরকার নাই মা। ফেলে দিন। ননাংরা কথাগুলি বলবেন না। চায়ে তোজলী সামান্য ওভালটিন দিয়েছে। আপনি ওভালটিনের গন্ধ পাচ্ছেন। আপনি চায়ের কাপটা দিন, আমি ফেলে দেই।
হাজেরা বিবি বললেন, ফেলবা কেন? খাইতে তো চমৎকার হইছে।
নাদিয়া তার বাবাকে বলল, চা খেতে কেমন হয়েছে বাবা?
হাবীব বললেন, ভালো হয়েছে।
আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াব।
আচ্ছা।
ম্যাজিক দেখবে বাবা?
তুই ম্যাজিক জানিস না-কি?
অল্প কয়েকটা জানি। আমার ডান হাতে কী আছে দেখো তো। একটা কয়েন।
হুঁ।
এই কয়েনটা আমি ডান হাত থেকে বাম হাতে নিয়ে গেলাম। ঠিক কি না বলো?
হুঁ। ঠিক।
নাদিয়া বা হাত খুলে দেখাল হাত শূন্য। হাবীব বিস্মিত হয়ে বললেন, কীভাবে করলি?
নাদিয়া বলল, পামিং করে করেছি। কয়েনটা সবসময় আমার ডান হাতেই ছিল। তোমার মনে হয়েছে আমি বাঁ হাতে চালান করেছি। আসলে তা-না। একে বলে পামিং। হাতের তালুতে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার বিদ্যা। এখন আমি দিনরাত পামিং প্র্যাকটিস করি।
পড়াশোনা বাদ দিয়ে পামিং?
নাদিয়া বলল, আমি পড়াশোনার বিষয়ে খুব সিরিয়াস বাবা। পামিং প্র্যাকটিস করি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে।
হাবীব বললেন, হঠাৎ এইসব ধরলি কেন?
নাদিরা বলল, ম্যাজিকে হঠাৎ উৎসাহ কেন হয়েছে তোমাকে বলি। ক্লাসে গিয়েছি। বিদ্যুত স্যারের ক্লাস। বিদ্যুত কান্তি দে। উনি মধ্যাকর্ষণ সূত্র পড়াবেন। স্যার ক্লাসে ঢুকলেন হোমিওপ্যাথির ওষুধ রাখে এরকম ছোট্ট একটা শিশি নিয়ে। শিশিটা তিনি টেবিলে রাখলেন এবং বললেন, প্রিয় শিষ্যরা। এই বোতলটা কি আপনাআপনি শূন্যে ভাসবে?
আমরা সবাই বললাম, না।
তিনি বললেন, কেন আপনাআপনি শূন্যে ভাসবে না?
আমরা বললাম, মধ্যাকর্ষণ বলের জন্যে শূন্যে ভাসবে না। পৃথিবী তাকে নিজের দিকে টেনে ধরে রাখবে।
স্যার তখন বোতলের দু’হাত ওপরে ব্ল্যাক বোর্ডের ডাস্টার ধরলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখি বোতলটা টেবিল ছেড়ে শূন্যে ভেসে উঠল। স্যার বললেন, প্রিয় শিষ্যকুল। যা দেখেছ তাতে বিভ্রান্ত হয়ো না। এটা একটা সাধারণ ম্যাজিক। কারোরই ক্ষমতা নেই মধ্যাকর্ষণ বল অগ্রাহ্য করার। স্যার বললেন, তোমরা কি এই ম্যাজিক দেখে খুশি হয়েছ?
আমরা সবাই একসঙ্গে বললাম, জি স্যার।
তিনি বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক হচ্ছে সায়েন্স। আমরা সেই ম্যাজিকে এখন ঢুকব। সায়েন্সের ম্যাজিক আমরা যতই জানব ততই আমরা অবাক হব। বিস্মিত হব, মুগ্ধ হব। এখন প্রিয় শিষ্যকুল হাততালি দাও, আমি বক্তৃতা শুরু করি।
আমরা হাততালি দিলাম।
স্যার বললেন, মহাকর্ষ বল যিনি প্রথম টের পেয়েছিলেন সেই মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে এক মিনিট standing ovation দিলে কেমন হয়!
আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর স্যার বক্তৃতা শুরু করলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম।
তোর এই স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের শিষ্য ডাকেন?
হুঁ। প্রাচীন গ্রীসের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের শিষ্য ডাকতেন। তিনিও তাই করেন।
তোর এই স্যার বিজলি না বিদ্যুত?
বিদ্যুত। বিদ্যুত কান্তি দে।
তিনিই তোকে ম্যাজিক শেখান? তিনি কি তোর ম্যাজিকেরও শিক্ষক?
আমি একদিন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম বোতল কীভাবে শূন্যে ভাসে তা শেখার জন্যে। তখন স্যার পামিং-এর কৌশল শিখিয়েছিলেন।
হাবীব গম্ভীর গলায় বললেন, তুই কি একাই তার কাছে ম্যাজিক শিখিস? নাকি সব শিষ্যদেরই তিনি ম্যাজিক শেখান?
নাদিয়া বলল, বাবা, তুমি কি কোনো কারণে স্যারকে অপছন্দ করছ?
হাবীব বললেন, পছন্দ-অপছন্দের বিষয় না। একজন ফিজিক্সের শিক্ষক ছাত্রদের ফিজিক্স শেখাবেন। ম্যাজিক না।
নাদিয়া বলল, আইনস্টাইন ছিলেন ফিজিক্সের গ্র্যান্ডমাস্টার। তিনি বেহালা বাজাতেন।
হাবীব বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক।
নাদিয়া বলল, বিদ্যুত স্যার একদিন ক্লাসে কী করেছিলেন সেই গল্পটা করি বাবা। তুমি খুব মজা পাবে।
হাবীব বললেন, তোর স্যারের প্রসঙ্গ নিয়ে এক দিনে অনেক আলাপ হয়ে গেছে। আজ আর না।
নাদিয়া বলল, স্যারের একটা কথা তোমাকে বলতেই হবে। তিনি একটা বিষয়ে তোমার সাহায্য চান।