তোমার শ্বশুর পাকা ঘর তুলল। নটিবেটিরে এই ঘরে আইন্যা দাখিল করল। আইজ সেই ঘরের নাম ‘অতিথঘর। বুঝেছ?
জি। আপনার ছেলেকে কেন ডুকিছিলেন আম্মা? কিছু লাগবে?
হাজেরা বিবি বললেন, শিল পড়েছে শুনেছি। একটা শিলে মধু মাখায়া আমার মুখে দেও। আমি চুষব। বছরের প্রথম শিলের মধ্যে ওষুধ থাকে। এই ওষুধ শরীরের জন্যে ভালো। ব্যবস্থা করা।
ব্যবস্থা করছি আম্মা।
হাসান রাজা চৌধুরীর সারা শরীর ভেজা। মাথার চুল বেয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে। লাইলী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। সে যে এত রূপবান তা তার কল্পনাতেও আসেনি।
লাইলী বললেন, বাবা, কেমন আছ?
ভালো।
আমি ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ির নাম কইতর বাড়ি না?
জি।
কইতরগুলি কি এখনো আছে?
জি।
শুনেছিলাম তোমার মায়ের মৃত্যুর দুইদিন আগে সব কইতর চলে গিয়েছিল। এটা কি সত্যি?
জি।
কতদিন পর ফিরে আসে?
মা’র কুলখানির দিন।
শুনেছি তোমার অসুখ। চিকিৎসা চলছে। কী অসুখ?
আমার কোনো অসুখ নাই। এই বাড়িতে আমি পালিয়ে আছি।
মলিনা পালাভর্তি ফুলকো লুচি এবং গরুর মাংস নিয়ে ঢুকেছে।
লাইলী বললেন, বাবা খাও।
হাসান খেতে শুরু করেছে। আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। লাইলী ইশারায় মলিনাকে চলে যেতে বললেন। মলিনা পুরোপুরি চলে গেল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে রাখল।
লাইলী বললেন, এখন থেকে তুমি এই ঘরে বসে খাবে। আমি সামনে থাকব।
হাসান বলল, আমার একা খেতে ভালো লাগে। মা মারা যাওয়ার পর একা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে।
লাইলী বললেন, অভ্যাসটা বদলানো দরকার। একদিন বিবাহ করবে। তোমার স্ত্রী চাইবে সামনে বসে তোমাকে খাওয়াতে।
আমি বিবাহ করব না।
তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা। তুমি কেন এই বাড়িতে পালিয়ে আছ?
হাসান বলল, আমি একটা খুন করেছি। এইজন্যে পালিয়ে আছি।
লাইলী তাকিয়ে আছেন। হাসান মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মলিনা ছটফট করছে, কারণ সে লাইলীর প্রতিটি কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তরে ওই মানুষটা কী জবাব দিয়েছে তা শুনতে পারে নাই।
প্রণব খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়েছেন। তিনি খবরের কাগজ পড়েন হাতে লাল-নীল পেনসিল নিয়ে। যেসব খবর পড়ে তার শান্তি লাগে সেখানে নীল দাগ দেন। অশান্তির খবরগুলিতে লাল দাগ। লাল এবং নীল দাগ সমান সমান হলে তার বড়ই আনন্দ লাগে। মাঝে মাঝে তিনি বিভ্রান্ত বোধ করেন। লাল দাগ না নীল দাগ দিবেন বুঝতে পারেন না।
আজও একটা বিভ্রান্তি দেখা দিল একচল্লিশজন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, আমরা সংবাদপত্র মারফত জানিয়া বিস্মিত হইলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল বাংলা বর্ণমালা, লিখন রীতি এবং বানান পদ্ধতির পরিবর্তন সাধনে তৎপর হইয়াছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা ভাষার এইরূপ পরিবর্তন সাধনে একতরফাভাবে কেন যে উদ্যোগী হইয়াছেন তাহা জানি না….
প্রণবের মনে হলো বাংলা ভাষা রক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে এটা ভালো কথা। নীল দাগ দেওয়া উচিত। আবার বিবৃতির কারণে দেশ আন্দোলনের দিকে যাবে। যেকোনো আন্দোলনের একপর্যায়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। কাজেই লাল দাগ।
আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে যাচ্ছে।—এটাও লাল দাগ। কারণ ফলাফল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা।
নীল দাগ দেওয়ার মতো একটা বর পাওয়া গেল। বোয়াল মাছের পেটে চার ভরি স্বর্ণের হার।
বোয়াল ধরা পড়েছে হাকালুকি হাওরে। তার পেট কেটে চার ভরি ওজনের হার পেয়েছে জেলে মন্তাজ মিয়া। সে বাজারে মাছ বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিল। খদ্দের না জোটায় মন খারাপ করে মাছ বাড়িতে নিয়ে যায়। মাছ কাটার পর হতদরিদ্র মন্তাজ মিয়ার পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
পত্রিকায় মন্তাজ মিয়ার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। সে গোমড়ামুখে একটা হার ধরে আছে। ছবি দেখে মনে হচ্ছে পেটে হার পেয়ে সে মহাবিরক্ত।
নাদিয়াকে ময়মনসিংহ নিয়ে যেতে রশিদ এসেছে
নাদিয়াকে ময়মনসিংহ নিয়ে যেতে রশিদ এসেছে। নাদিয়া বলল, আমি একা যাওয়া আসা করতে পারি। কেন আমাকে নিতে আসেন।
রশিদ জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রশ্ন করলেই উত্তরে কিছু বলা রশিদের স্বভাবে নেই।
নাদিয়া বলল, আপনি ভালো সময়ে এসেছেন। ইউনিভার্সিটি সাত দিনের ছুটি হয়েছে। আয়ুব খান আসছেন এইজন্যে ছুটি। আমরা ছাত্ররা ঝামেলা করে ফেলতে পারি এটাই সরকারের ভয়।
রশিদ বলল, আম্মা, কখন রওনা দিবেন?
ট্রেন কখন?
আমি স্যারের গাড়ি নিয়া আসছি আম্মা। আপনি যখন রওনা দিতে চান তখন রওনা দিব। দুপুরের আগে রওনা দেওয়া ভালো। সইন্ধ্যায় সন্ধ্যায় পৌঁছব।
আমি গাড়িতে যাব না। ট্রেনে যাব। এবং একা যাব। আজ না, আগামীকাল। ‘রোমান হলিডে’ নামে একটা ছবি এসেছে। হলের অনেক মেয়ে ছবি দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। আমি এখনো কাঁদতে পারিনি।
রশিদ বলল, আম্মা আপনারে না নিয়া গেলে স্যরি আমারে খুন করবে।
নাদিয়া বলল, বাবা আয়ুব খানের মতো। নানান প্যাঁচ খেলবে, খুন করবে। আপনি গাড়ি নিয়ে ফেরত যান। আমি এক থেকে তিন গুনব, আপনি এর মধ্যে বিদায় হবেন। এক-দুই-তিন।
ছুটি সাত দিনের, নাদিয়া জানে খুব কম করে তাকে দশ দিন থাকতে হবে। দাদি ছাড়বে না। ঢাকায় আসার জন্যে সে তৈরি হয়ে দাদিকে সালাম করতে যাবে। দাদি বলবেন, খারাপ খোয়াব দেখছি। খুবই খারাপ খোয়াব। আইজ যাওয়া বন। পরের দিন দাদি বলবেন, আইজ না শনিবার। শনিবারের যাত্রা! তোর মাথাটা কি খারাপ হইছে? তারপরের দিন দাদি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তার হাঁপানির টান উঠবে। অসুখ সত্যি না মিথ্যা কেউ ধরতে পারবে না।