হাবীব বললেন, পরিস্থিতির কারণে মাঝে মধ্যে হাতি দুর হয়ে যায়। এই ছেলে এখন ইদুর! এর বেশি আমারে কিছু জিজ্ঞাসা করবা না।
আম্মা নাদিয়াকে আনার জন্যে লোক পাঠাতে বলেছেন।
হাবীব বললেন, আম্মার কথা আমার কাছে আদেশ। লোক পাঠাও। ইউনিভার্সিটিতে নানান গোলমাল চলতেছে। ছাত্রগুলা কৈ মাছের মতো উজাইছে। এই সময় হল-হোস্টেলে না থাকা উত্তম।
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ ঝড় উঠল। আম-কাঁঠালের বাগানের ভেতর ধুলা-আবর্জনার কুলি উঠল। লাইলী ঘোমটা মাথায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তার ঝড়.. বৃষ্টি ভালো লাগে। ঝড়ের সময় ঘূর্ণি ওঠার অন্য অর্থ আছে। ছোটবেলায় শুনেছেন ঘূর্ণির ভেতর একটা করে জ্বিন থাকে। নজর করে দেখলেই হঠাৎ হঠাৎ জ্বিনের হাত-পা-মাথা আচমকা দেখা যায়।
লাইলী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বাগানে তিনটা ঘূর্ণি উঠেছে। এর পাক খেয়ে খেয়ে একটার সঙ্গে অন্যটা মিশে যাচ্ছে। আবার আলাদা হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে জ্বিনরা কেউ থাকবে না। এরা বৃষ্টি পছন্দ করে না।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছিল। এখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। লাইলীর চোখে পড়ল পুকুরঘাটে হাসান রাজা চৌধুরী দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। সে মনের আনন্দে ভিজছে।
যে মাওলানার কাছে লাইলী ছোটবেলায় আরবি পড়া শিখতেন তিনি বলতেন, বৃষ্টি আল্লাপাকের খাস রহমতের একটি। বৃষ্টিতে ভিজলে উনার রহমত গায়ে মাখা হয়। এটা শরীর এবং মন দুইয়ের জন্যই ভালো। তবে এই রহমত আল্লাহপাক শুধু মানুষের জন্যে দিয়েছেন। জ্বিনের জন্যে দেন নাই। জ্বিনরা বৃষ্টিতে ভিজতে পারে না।
লাইলী বলেছিল, জ্বিনদের জন্য কি অন্য কোনো রহমতের ব্যবস্থা আছে?
তিনি বললেন, আছে। আল্লাপাক জ্বিনের জন্যে আগুনের বৃষ্টির ব্যবস্থা রেখেছেন। আগুনের বৃষ্টি তাদের জন্যে।
লাইলী মাওলানা সাহেবের নাম মনে করার চেষ্টা করছেন। নাম মনে আসছে না। কিছু নাম মানুষ অতিদ্রুত ভুলে যায়, হাজার চেষ্টা করলেও মনে করতে পারে না। মনে হয় আল্লাপাক চান না এই নামগুলি মনে থাকুক।
সেই মাওলানার অভ্যাস ছিল কথা বলার সময় ছাত্রীর পিঠে হাত রাখা। একদিন তিনি বললেন, তুমি উড়না ঠিকমতো পরতে পারো না। মাথার উড়না এমনভাবে দিতে হবে যেন মাথার সামনের চুল ঢাকা পড়ে। আমি উড়না পূরায়ে তোমারে দেখায়ে দিতেছি। তিনি উড়না পরাবার সময় লাইলীর বুকে হাত রাখলেন। লাইলী পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। তখন তার বয়স বারো। এই ভয়ঙ্কর ঘটনা কাউকে বলার উপায় নাই, কারণ কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। মাওলানা ছিলেন তাদের অঞ্চলের অতি সম্মানিত মানুষদের একজন।
হঠাৎ লাইলীর মাওলানার নাম মনে পড়ল। মাওলানা আসগর। আজ দুপুরে খাওয়ার সময় নাদিয়ার বাবা এই নাম উচ্চারণ করেছেন।
লাইলী নিচুগলায় কয়েকবার বললেন, মাওলানা আসগর। মাওলানা আসগর।
কাজের মেয়ে মলিনা এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়েটার বয়স অল্প। অল্প বয়সের কারণেই সে তুচ্ছ বিষয়ে উত্তেজিত হয়।
আম্মা, শিল পড়তাছে!
লাইলী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বাগানের দিকে তাকালেন—শিল পড়ছে। হাসান রাজা চৌধুরী ছোট বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করে শিল কুড়াচ্ছে। লাইলী বলেছেন, মলিনা! তুমি খোঁজ নাও তোমার খালু বাড়িতে বা চেম্বারে আছেন কি না। থাকার কথা না। আজ বৃহস্পতিবার। তিনি ৩াশ খেলতে যান। যদি দেখো তোমার খালু নাই, তাহলে ওই ছেলেটারে বলবা আমি চা-নাশতা খাওয়ার জন্যে তাকে ডেকেছি।
দোতলায় নিয়ে আসব আম্মা?
হ্যাঁ, দোতলায় আনবা। চা-নাশতার ব্যবস্থা করবা।
কী নাশতা দিব?
লুচি ভাইজ্যা দিবা। মাংস রান্না আছে। মাংস লুচি।
মলিনা গলা নামিয়ে বলল, কেউ যেন না জানে এমনভাবে আনব আম্মা?
লাইলী বললেন, লুকাছাপার কিছু নাই। তুমি অল্পদিন হয়েছে এই বাড়িতে এসেছ। তুমি আমাকে চিনো না। আমারে চিনলে বুঝতা আমার মধ্যে লুকাছাপা নাই।
মলিনা চলে গেল। লাইলীর মন সামান্য খারাপ হলো, কারণ মলিনাকে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। তাঁর মধ্যে অবশই লুকাছাপা আছে। মাওলানা আসগরের কথা তিনি কাউকে বলেন নাই। ছেলেটাকে নাশতা খেতে খবর দিয়েছেন, কিন্তু তার আগে খোঁজ নিয়েছেন নাদিয়ার বাবা তাশ খেলতে গেছেন কি না।
হাজেরা বিবি চেঁচাচ্ছেন, ও হাবু! হাবুরে! ও হাবু!
লাইলী শাশুড়ির ঘরে ঢুকলেন।
আম্মা, কিছু লাগবে?
আমার ছেলে কই? হাবলাটা কই?
আজ বৃহস্পতিবার, মনে হয় তাশ খেলতে গেছে।
হাজেরা বিবি বললেন, সত্যি সত্যি তাশ খেলতে যায় কি না, ভালোমতো খোঁজ নিবা। পুরুষমানুষরে বিশ্বাস করবা না। তারা এক জায়গায় যাওয়ার কথা বলে যায় অন্য জায়গায়। তোমার শ্বশুরের কথা শোনো। সে মাসের প্রথম দিন…
লাইলী বললেন, এই গল্প অনেকবার শুনেছি আম্মা।
আরেকবার শোনো। একটা শাড়ি অনেকবার পরেছ বলে আর পরতে পারবা না, তা তো না। ভালো শাড়ি অনেকবার পরা যায়। তারপর ঘটনা শোনো। তখন আমি নতুন বউ। এই বাড়ির হালচাল বুঝি না। বয়সও কম। হায়েজ নেফাস শুরু হয় নাই এমন কম। তারপরেও সন্দেহ হইল। খোঁজ লাগায়া জানলাম তোমার শশুর যায় নটিবাড়িতে। নটির নাম বেদানা। আমি তোমার শ্বশুররে বললাম, আপনে সম্মানী মানুষ। নটিবাড়িতে কেন যাবেন! নটি আসবে আপনার কাছে। বেদানারে আপনার কাছে আইন্যা রাখেন।