আমি মেম্বার হওয়ার জন্যে গিয়েছিলাম। জামানতের টাকা ছিল না বলে মেম্বার হতে পারি নাই।
আসগর তোষকের নিচ থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, আমার পক্ষে মেম্বার হওয়া সম্ভব না। আপনি মেম্বার হবেন। বই এনে আমাকে দিবেন। আমি পড়ে ফেরত দিব।
জি আচ্ছা।
আরেকটা ছোট্ট কাজ করতে পারবেন? রশিদ নামের একজন আমার জন্যে তিনবেলা টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার আনে। আমি যখন খানা খাই, সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি খেতে পারি না। তাকে বলবেন সে যেন সামনে দাঁড়িয়ে না থাকে। আমি নিজেও বলতে পারতাম। কিন্তু আমি লজ্জা পাচ্ছি।
ফরিদ ভয়ে ভয়ে বলল, আপনার মাথার অসুখটা কি একটু কমেছে?
আমার মাথার কোনো অসুখ নাই। কাজেই অসুখ বাড়া-কমার প্রশ্ন আসে না। আচ্ছা আপনি এখন যান।
ফরিদ লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছে। সে সপ্তাহে দু’বার লাইব্রেরি থেকে বই আনে। অন্যের জন্যে বই আনা-নেওয়া করতে করতে ফরিদের নিজের বই পড়া অভ্যাস হয়ে গেল। ফরিদ চার নম্বরি হাতিমার্কা একটা খাতা কিনেছে। যে সব বই সে এনেছে তার নাম খাতায় লিখে রাখছে। লাইব্রেরি থেকে বই আনার সময় খাতাটা সে নিয়ে যায়। খাতা দেখে বই নেয়, যাতে একই বই দুইবার নেওয়া না হয়। কোন বই তার নিজের পড়ে কেমন লাগল তাও অল্পকথায় লিখে রাখে।
যেমন–
দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার : মোটামুটি।
ভারতবর্ষের ইতিহাস : খুবই বাজে।
দুটি ফুল এক বৃন্ত : ভালো। প্রেমের বই।
জানবার কথা : জ্ঞানের বই। মোটামুটি।
দস্যু বাহরাম : খুবই ভালো।
প্রেত কাহিনী : অত্যধিক ভালো। ভূতের।
কপালকুণ্ডলা : ভাষা খারাপ। বই খারাপ।
পথের দাবী : খুবই সুন্দর।
পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ানের নাম ক্ষিতিশ বাবু। বয়স ষাট। সারা দিন চা এবং পান খান। মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ বিপরীত দুই বস্তু একসঙ্গে খান। তাঁর মুখের সামনে সবসময় বই ধরা আছে। তিনি ঘোষণা করেছেন, এই লাইব্রেরির সব বই যেদিন পড়ে শেষ করবেন সেদিন …লের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ধর্মকর্মে মন দিবেন। অল্পদিনেই ফরিদের সঙ্গে তাঁর ভালো খাতির হয়েছে। বই লেনদেনের সময় কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেন।
ফরিদ, বলো দেখি বই পড়লে কী হয়?
জ্ঞান হয়।
পারলা না। জ্ঞান এত সোজা জিনিস না—বই পড়ল জ্ঞান হয়ে গেল। বই পড়লে পাপক্ষয় হয়। আজেবাজে বই পড়লে ছোটখাটো পাপক্ষয় হয়, ভালো বই পড়লে বড় পাপক্ষয়। বুঝেছ?
বুঝার চেষ্টা নিতেছি।
গঙ্গায় ডুবলে হিন্দুর পাপক্ষয় হয়—এইটা জানো তো?
জানি।
পুস্তক হলো হিন্দু-মুসলমান সবেরই গঙ্গাপুস্তকে ডুব দিলে হিন্দু-মুসলমান সবের পাপক্ষয় হয়। মনে থাকবে?
থাকবে।
গঙ্গায় ডুব দিয়া পাপক্ষয়ের মন্ত্রটা জানো?
জে-না।
মন্ত্রটা শোনো
আম্র চুরি, জাম্র চুরি
ভাদ্র মাসে ধান্য চুরি
মন্দস্থানে রাত্রিযাপন
মদ্য পান আর কুকড়া ভক্ষণ
হক্কল পাপ বিমোচন
গঙ্গা গঙ্গা।
এখন যাও বই নিয়া বিদায় হও। তোমার সঙ্গে কথা বলার কারণে বইপড়া বন্ধ, আমার পাপ কাটাও বন্ধ। বিদায়।
ফরিদ বলল, স্যার, আমার খুব শখ আপনারে একবেলা খাওয়াই।
শখ হইলে খাওয়াবা। মুসলমানের বাড়িতে খাইতে আমার সমস্যা নাই।
ফরিদ বলল, নিজের যেদিন রোজগার হবে তখন খাওয়াব। এখন আমি পরের বাড়িতে আশ্রিত।
ক্ষিতিশ বাবু বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন—আশ্রিত অবস্থার পরিবর্তন করো। আশ্রিত মানুষের অন্ন বিষ্টাবৎ। বিষ্টা বোঝা তো?
বুঝি।
বিষ্টা আর কত খাইবা? খাদ্য খাও।
খুব শিগগিরই একটা ব্যবস্থা হবে স্যার।
ফরিদ ক্ষিতিশ বাবুর পায়ের ধুলা নিয়ে বের হয়ে এল। এই কাজটি সে সবসময় করে। বিদায়ের সময় ক্ষিতিশ বাবুর পায়ের ধুলা নেয়।
হাবীব খেতে বসেছেন। পাটি পেতে খেতে বসা। তার সামনে পাখা হাতে লাইলী একটা জলচৌকিতে বসেছেন। লাইলী পাখা হাতে নিয়েছেন অভ্যাসের কারণে। খাওয়ার সময় হাবীব পাখা নাড়ানাড়ি পছন্দ করেন না। কথা চালাচালিও পছন্দ করেন না। এই কথা তিনি তাঁর স্ত্রীকে অনেকবার বলেছেন। কিন্তু লাইলীর মনে থাকে না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি খাবার সময় বলবেনই।
লাইলী বললেন, অতিথঘরে যে থাকে সে কে?
হাবীব বললেন, তার নাম আসগর। আসগর আলি। আমার দূরসম্পর্কের ভাইগ্না হয়। বাড়ি শম্ভুগঞ্জ। শরীর খারাপ। চিকিৎসার জন্যে এসেছে।
লাইলী বললেন, খাওয়ার সময় মিথ্যা বললে গলায় ভাত আটকাইয়া মৃত্যু হয়। খাওয়া শেষ করেন, তারপর মিথ্যা বলবেন।
হাবীব কিছুক্ষণ কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে আবার নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করলেন।
লাইলী বললেন, এই ছেলেরে আমি চিনি। সে ভাটিপাড়ার বারোআনি জমিদার রহমত রাজা চৌধুরী সাবের একমাত্র ছেলে, তার নাম হাসান রাজা চৌধুরী।
তুমি চিনলা কীভাবে?
আপনার ইয়াদ থাকে না যে, আমি ভাটি অঞ্চলের মেয়ে। ভাটিপাড়ায় আমার খালার বাড়ি। আমি ছোটবেলায় জমিদার সাবের বাড়িতে গিয়েছি। এত সুন্দর আর এত বড় বাড়ি ভাটি অঞ্চলে নাই। উনাদের বাড়ির নাম কইতর বাড়ি।
কইতর বাড়ি নাম কী জন্যে?
বাড়িভর্তি কইতর। এইজন্যে বাড়ির নাম কইতর বাড়ি। কইতরগুলির জন্যে প্রতিদিন আধম ধান বরাদ্দ ছিল, এখন কী অবস্থা জানি না।
হাবীব বললেন, কম জানাই ভালো। বেশি জানলে সমস্যা।
লাইলী বললেন, জমিদার সাবের ছেলে একলা অতিথবাড়িতে থাকে, একলা খায়—এইটা কেমন কথা? তারে মূল বাড়িতে থাকতে বলেন। আমি যত্ন করে খাওয়াব।