লিখেছি।
লেখো—আমার অন্তিম সময় উপস্থিত হইয়াছে। এই বিষয়ে আজরাইল আলায়হেস সালামের সঙ্গে কথা হইয়াছে। তিনি সঠিক দিনক্ষণ বলেন নাই। কিন্তু ইশারায় জানায়েছেন।
লাইলী বললেন, আস্তে আস্তে বলেন আম্মা। এত তাড়াতাড়ি লিখতে পারি। আজরাইল আপনাকে কী ইশারা দিয়েছে?
হাজেরা বিবি বললেন, উনি বলেছেন—তোর যা খাইতে মন চায় তাড়াতাড়ি খায়া নে?
লাইলী বললেন, কী খেতে আপনার মন চায়?
হাজেরা বিবি বললেন, পাকনা তেতুই খাইতে মন চায়, ডেফল খাইতে মন চায়, বুবি খাইতে মন চায়। এইসব ফল চুকা। বেহেশতে মিলবে না। বেহেশতের সব ফল মিষ্টি।
লাইলী বলেন, এখন কী লিখব বলেন–
লেখো-পত্র পাওয়া মাত্র চলিয়া আসিবে। জান কবজের আগে আগে যেন তোমার মুখ দেখি। তোমার সহিত আমার কিছু গোপন কথাও আছে। এই পত্রকে টেলিগ্রাম মনে করিয়া চলিয়া আসিবা। ইতি তোমার দাদি হাজেরা বিবি।
লাইলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আম্মা এখন যাই, চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করি।
হাজেরা বললেন, চিঠি ডাকে দিবা না। ডাকের চিঠির গুরুত্ব নাই। হারামজাদা ফরিদরে বলো চিঠি হাতে হাতে নিয়া যাবে এবং তোজ্জল্লীরে সাথে। কইরা নিয়া আসবে। সে আজই যাবে।
আচ্ছা।
আইজ কী বার?
বুধবার।
বুধবার হইলে আইজ যাবে না। বুধবার দিন খারাপ। তোমার মা মারা গিয়েছিলেন বুধবারে। লতিফা বিষ খাইছিল মঙ্গলবার রাতে। মারা গেল বুধবারে। হারামজাদা ফরিদরে পাঠাইবা বিষুদবার সকালে। ঠিক আছে।
জি, ঠিক আছে। আম্মা, আমি এখন যাই? না-কি আরও কিছু বলবেন?
হাজেরা বিবি জবাব দিলেন না। তিনি রোদে পা রাখার এবং পা সরিয়ে নেওয়ার খেলা খেলছেন।
ফরিদ তার ঘরে কাঠের চেয়ারে বসে আছে। চেয়ারের একটা পা ভাঙা বলে কোনো কিছুর সঙ্গে ঠেশ না দিয়ে বসা যায় না। সে চেয়ারটাকে খাটের সঙ্গে ঠেশ দিয়েছে। জায়গাটা ভালো পাওয়া গেছে। এখান থেকে জানালা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। তার দৃষ্টিসীমায় একতলা একটা পাকা বাড়ি। এটা ‘অতিথঘর’। অতিথিদের থাকার ঘর। ঘরের ভেতরটা ফরিদ কোনোদিন দেখে নাই। শুনেছে সুন্দর করে সাজানো। পাশাপাশি দুটা খাট আছে। চেয়ার-টেবিল আছে। মাথার ওপর টানা পাখার ব্যবস্থাও আছে। বিশেষ কোনো অতিথি এলে পাংখাপুলারের ব্যবস্থা করা হয়।
বাড়ির সামনে গেটের মধ্যে আছে। গেটে ঝুমকা লতা এবং নীলমণি লতা। নীলমণি লতায় ফুল ফুটেছে। গেট নীল হয়ে আছে। ফরিদের ধারণা এই ফুলগুলির দিকে চেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায়।
অতিথঘরে সম্প্রতি একজন অতিথি এসেছে। বয়স অল্প। ফরিদ এই অতিথির রূপ দেখে চমৎকৃত। কোনো পুরুষমানুষ এত রূপবান হতে পারে তা ফরিদের ধারণাতেও ছিল না। ফরিদ তার স্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে কথাও বলেছে। সফুরা বলল, উনার কোনো একটা খুঁত আছে। খুঁত ছাড়া মানুষ এত সুন্দর হয় না। মাকাল ফল এত সুন্দর, তার কারণ ফল বিষাক্ত।
ফরিদ বলল, সফুরা, মানুষের সৌন্দর্য দেখবা। খুঁত দেখবা না।
খুঁত দেখব না কেন?
ফরিদ বলল, খুঁত দেখলে মন খারাপ হবে—এইজন্যে দেখবা না। আমাদের চেষ্টা থাকা উচিত যেন সবসময় মন ভালো থাকে।
সফুরা বলল, কেন?
ফরিদ বলল, মানুষের মনের সঙ্গে আল্লাহপাকের যোগাযোগ আছে। মানুষের মন খারাপ হলে উনার খারাপ লাগে।
আপনারে কে বলেছে?
আমি চিন্তা কইরা বাইর করছি।
আপনে দেখি বিরাট চিন্তার লোক।
ফরিদ বলল, কাজকর্ম নাই তো। চিন্তা ছাড়া কী করব বলো?
সফুরা বলল, কাজকর্মের চেষ্টা করেন।
ফরিদ বলল, চিন্তা করাটাও একটা বড় কাজ।
এখন কী নিয়া চিন্তা করেন?
নতুন যে অতিথি আসছে তার বিষয়ে চিন্তা করি।
সফুরা বলল, তার বিষয়ে চিন্তার কিছু নাই। উনি স্যারের দূরসম্পর্কের ভাইগ্না। মাথায় কী যেন দোষ হয়েছে। কবিরাজী চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছেন। চিকিৎসায় আরাম না হলে কলিকাতা যাবেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলা নিষিদ্ধ। কথা বললে উনার রোগ বাড়ে।
এইসব তথ্য ফরিদ জানে, তবে সে সামান্য বেশি জানে। কারণ মানুষটার সঙ্গে একরাতে তার আলাপ হয়েছে। সেই রাতে শহরে কারেন্ট ছিল না। গরম পড়েছিল অত্যধিক। পাংখাপুলার রশিদ এসে তাকে বলল, স্যারের অর্ডার হয়েছে রাতে আপনি অতিথঘরে যাবেন। সারা রাত পাংখা টানবেন। অতিথের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বলবেন না।
ফরিদ বলল, উনি যদি কিছু জিজ্ঞাস করেন চুপ করে থাকব?
রশিদ বলল, সেটা আমি বলতে পারব না। নিজ বিবেচনায় কাজ করবেন।
উনার নাম কী?
আসগর।
ফরিদ পাংখা টানতে গেল। আসগর বিছানায় শুয়ে ছিল। উঠে বসল এবং বলল, পাংখা টানতে হবে না। কেউ পাংখা টানলে আমার ঘুম হয় না।
ফরিদ বলল, স্যার অর্ডার দিয়েছেন। পাংখা না টানলে উনি রাগ করবেন। রাগ করলে করবেন।
আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ, চলে যাবেন। এই বাড়িতে কি পড়ার মতো কোনো বই আছে? যে-কোনো বই। আমার সময় কাটে না। বই থাকলে পড়তাম।
ফরিদ বলল, আপার অনেক বই আছে। আলমারি ভর্তি বই। কিন্তু আপার ঘর তালা দেওয়া।
উনি কোথায়?
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। রোকেয়া হলে থাকেন।
কী পড়েন?
ফিজিক্সে অনার্স। আপনি বই পড়তে চাইলে আরেকটা বুদ্ধি আছে।
কী বুদ্ধি?
ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। তার মেম্বার হলে বই এনে পড়তে পারবেন। লাইব্রেরিতে জামানত হিসাবে কিছু টাকা জমা রাখতে হবে। কুড়ি টাকা। মাসিক চাঁদা এক টাকা।
এত কিছু জানেন কীভাবে?