যাই হক, পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রাতে নিচে খেতে গিয়ে দেখি, ছোট চাচার ব্যাপারটা সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছে।
মীরা বলছে, আমি যা আগেই সন্দেহ করেছিলাম। ইদানীং কেমন সেজেগুজে আসছিল।
এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা। সমিতা এ বাড়িতে সব সময় নার্সের পোশাক পরে আসে। বাড়তি কোনো রকম সাজসজ্জা তার নেই। সে আসে, নিজের মনে কাজ করে যায়। তাকে নিয়ে আমার বোনেরা যেসব কথাবার্তা বলে তা হচ্ছে কী দেমাগ। চার পয়সা দামের নার্সের এত দেমাগ হয় কী করে। তাও যদি চেহারাটা ভালো হত। আবলুস কাঠের মতো গায়ের রং। ঠোঁট দুটা পুরুষদের ঠোঁটের মতো মোটা।
এসব কথার কোনোটাই সত্যি নয়, সমিতার গায়ের রং কালো এবং ঠোঁট দুটাও মোটা, তবু এই মেয়ের দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে হয়। মীরা এবং ইরা যে এত কথা বলে তার কারণ সম্ভবত ঈৰ্ষা।
খাবার টেবিলে ছোট চাচাকে নিয়েই আলাপ চলতে লাগল। টেবিলে আছি শুধু আমরা অর্থাৎ মীরা, ইরা এবং বাবা। মা খাবার-দাবার এগিয়ে দিচ্ছেন এবং রাগে গন গন করছেন। মীরা-ইরা কিছুক্ষণ পর পর বলছে, এরকম একটা কুৎসিত কাজ কী করে করল। নার্স বিয়ে করে ফেলল–ছিঃ! এক পর্যায়ে বাবা বললেন, থা তো। একটা ব্যাপার নিয়ে এত কথা! বিয়ে যে করেই ফেলেছে এমন তো নাও হতে পারে। এই নিয়ে আর কোনো ডিসকাসন যেন না হয়।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই থেমে গেল। কোন কারণ ছাড়াই আমরা বাবাকে বেশ ভয় পাই। এর মধ্যে মাও আছেন। তিনি ভয় পান সবচে বেশি।
বাবা ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, এসব হচ্ছে পারিবারিক স্ক্যান্ডেল। ধামাচাপা দিতে হবে। মা ক্ষীণ গলায় বললেন, বিয়ে করে বসে আছে, এই জিনিস তুমি ধামাচাপা দেবে কিভাবে?
বাবা এমন ভঙ্গিতে মার দিকে তাকালেন যেন মার মুখতায় তিনি খুবই বিস্মিতবোধ করছেন। এই দৃষ্টিটি তিনি কোত্থেকে শিখেছেন কে জানে, তবে খুব ভালো শিখেছেন। এই দৃষ্টির মুখোমুখি আমাদের প্রায়ই হতে হয় এবং আমরা খুবই সংকুচিত বোধ করি।
বাবা হাত ধোবার জন্যে উঠতে উঠতে বললেন, সমস্যা যেমন আছে, সমস্যার সমাধানও আছে। আসগরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
জাজ সাহেব ফাঁসির হুকুম দিয়ে এজলাস থেকে নেমে গেলেন এরকম ভঙ্গিতে বাবা নিজের ঘরে রওনা হলেন। আমি ছোট চাচাকে খবর দিতে গেলাম।
ছোট চাচা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। বারান্দায় আলো নেই বলে তাঁর মনের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে বসে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে মন আলো নেই। যাদের মন হাসি-খুশি তারা বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকতে পারে না।
কী করছ চাচা?
কিছু করছি না। আঁধারের রূপ দেখছি। আচ্ছা, তুই কী বিয়ে নিয়ে কিছু বলেছিস? আমি সমিতাকে বিয়ে করে ফেলেছি এই জাতীয় কিছু?
বলেছি।
ছোট চাচা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভালই করেছিস। বিয়ে করে ফেললে কী রিএ্যাকশন হবে এ্যাডভান্স জানা গেল।
তোমাকে বাবা ডাকছেন।
কেন?
কোর্ট মার্শাল হবে বলে মনে হচ্ছে।
বলে আয় ঘুমিয়ে পড়েছি।
খাওয়া-দাওয়া করেছ?
আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তোক ভাবতে হবে না। তুই একটা কাজ কর তো—ছোট চাচীর ঘরে যা।
কী কবর ঘরে গিয়ে?
দেখে আয় সে ব্যাপারটা শুনেছে কি না।
আমার মনে হয় শুনেন নি।
মনে হওয়া-হওয়ি না-তুই জেনে আয়।
আমি ছোট চাচীর ঘরের দিকে রওনা হলাম। তাঁর ঘরে ঢোকার অনেক সমস্যা আছে খালি পায়ে ঢুকতে হয়। ছোট চাচী দিনের মধ্যে সতের বার মেঝেতে পা ঘষে ঘষে দেখেন বালি কিচমিচ করছে কি না। ছোট চাচীর ভাষায় তিনি পৃথিবীর সবকিছু সহ্য করতে পারেন, তবে, মেঝেতে বালি থাকলে তা সহ্য করতে পারেন না।
ছোট চাচীর ঘরে আসবাবপত্রও তেমন নেই। কারণ, শোবার ঘরে তিনি আসবাবপত্র সহ্য করতে পারেন না, তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। তাঁর প্রকাণ্ড ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা খাট। একপাশে গোল একটা টেবিল। সেই গোল টেবিলের মাঝখানে কাচের ফুলদানিতে দুটা গোলাপ। এই গোলাপ আসে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে। ছোট চাচীর বাবা রিটায়ার্ড জাজ হামিদুর রহমান সাহেব বর্তমানে গগালাপের চাষ করেন। ঢাকা শহর গোলাপ সমিতির তিনি সহ-সভাপতি। তাঁর বাগানে একান্নটা গোলাপের গাছ আছে। তিনি প্রতিদিন বাগানের গোলাপ তাঁর চার মেয়ের বাসায় দুটা করে পাঠান। সাইকেলে করে একটা শুটকো লোক গোলাপ দিয়ে যায়। এমনভাবে দেয় যেন সাত রাজার ধন দিয়ে যাচ্ছে। একবার আমার হাতে দিয়ে বলল, একটু কেয়ারফুলি ধরুন ভাই। আমি বললাম, কেন? বিষাক্ত না কি? লোকটা অত্যন্ত বিরক্ত হল।
পুরো ব্যাপারটা কেন জানি আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। রিটায়ার্ড জাজ হামিদুর রহমান সাহেবের এই গোলাপপ্রেমের বিষয়টি লোক-দেখানো বলেই আমার ধারণা। তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই তিনি গদ গদ ভঙ্গিতে গোলাপ সম্পর্কে এত সব কথা বলেন যে, রাগে গা জ্বলে যায়। শেষবার যেদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, তিনি বললেন, জানো টুকু, ঘুমুবার আগে গোলাপের ঘ্রাণ না নিলে আমার আলো ঘুম হয় না।
আমি নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম, যেদিন সর্দি থাকে সেদিন কী করেন? নিশ্চয়ই ঘুমের খুব অসুবিধা হয়।
জাজ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝতে চাইলেন আমি ঠাট্টা করছি কি না। আমি খুবই সরল ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলাম যেন সত্যি সত্যি জানতে চাই সর্দি হলে উনি কী করেন। রিটায়ার্ড জাজ সাহেবের শেষ পর্যন্ত ধারণা হল, আমি ঠাট্টা করছি না। জাজ সাহেবরা কে সত্যি কথা বলছে, কে বলছেনা, তা কখনো ধরতে পারেন না।