শার্ট খুলে বিছানায় এলিয়ে পড়তেই মা ঢুকলেন। আমি বিস্মিত হয়ে উঠে বসলাম। তিনি সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না বলে কখনো আমার ঘরে আসেন না। যখন আসেন তখন বুঝতে হবে ব্যাপার গুরুত্তর। আমি বললাম, কী ব্যাপার মা?
মা তেমন ভনিতা করতে পারেন না। সরাসরি মূল প্রসঙ্গে চলে আসেন। আজও তাই করলেন। শীতল গলায় বললেন, তোর ছোট চাচার ব্যাপার কিছু জানিস?
কোন ব্যাপার?
ঐ নার্স মেয়েটার সঙ্গে এর কিছু আছে নাকি বল তো?
আমি কী করে বলব?
তোর এই ছাদে এসেই তো দুজন ঘোরাঘুরি করে। তুই জানবি না কেন?
দুজন ছাদে আসে তোমাকে বলল কে?
ইরা বলেছে।
ইরা বললে মোটেই পাত্তা দিও না। ইরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে।
তোর ছোট চাচাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে কেন?
তাছাড়া ব্যাপারটা যদি সত্যিই হয়, তোমার তো কিছু করার নেই। ছোট চাচা কচি থোক না। সে যদি মনে করে সমিতাকে বিয়ে করবে তাহলে করবে। এটা তার ব্যাপার।
সমিতা আবার কে?
নার্সটার নাম সমিতা।
বিয়ে করার কথা আসছে কেন?
প্রেম হলে বিয়েও হতে পারে।
তোর ছোট চাচা কি তোকে কিছু বলেছে?
আমি অতি দ্রুত চিন্তা করলাম সত্যি কথাটা মাকে বলব, না কি বলব না। ছোট চাচা আমাকে যখন বলেছেন তখন নিশ্চয়ই এই ভেবেই বলেছেন যে আমার মাধ্যমে খবরটা আস্তে আস্তে ছড়াবে। এইসব ব্যাপার সরাসরি বলার চেয়ে ভায়া মিডিয়ায় বলা অনেক নিরাপদ। আর বলতেই যখন হবে; বাড়িয়ে বলাই ভালো। বিয়ে হয়ে গেছে বলে দেখা যাক কী রিএ্যাকশন হয়।
কথা বলছি না কেন? কিছু বলেছে?
হুঁ।
কী বলেছে?
সমিতাকে বিয়ে করেছেন এই রকম একটা কথাই মনে হল শুনলাম।
ফাজলামি করছিস কেন?
মোটেই ফাজলামি করছি না।
মা আমার বিছানার একপাশে বসে ডাঙায় ভোলা মাছের মতো বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। তার প্রায় মিনিট পাঁচেক পর ছোট চাচা ছাদে উঠে এসে বললেন, ভাবী আছেন নাকি? একটু আসুন তো, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
ছোট চাচা মার সঙ্গে কথা বলছেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। আমার ঘর থেকে তাঁদের কথা শোনা যায় না, কাজেই আমি সিঁড়ির দরজার কাছে নিঃশব্দে এগিয়ে এলাম। নিঃশব্দে চলাফেরাটা আমি বেশ ভালো পারি।
ছোট চাচাকে মনে হল খুবই স্বাভাবিক। সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছেন। প্রতিটি শব্দ বেশ স্পষ্ট, তবে মাঝে মাঝে তিনি এমন নিচু পর্দায় চলে যাচ্ছেন যে আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। সেই তুলনায় মার গলা ভয়াবহ। এমন চেঁচামেচি করছেন যে একতলার লোকজনও শুনতে পাচ্ছে বলে আমার ধারণা। মা এই ব্যাপারটা খুব সম্ভব ইচ্ছা করেই করছেন। একই সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন। ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরা খুব বুদ্ধি খাটাতে পারে। তাঁদের কথোপকথনের ধরনটা এ রকম–
ছোট চাচা : আস্তে কথা বলুন ভাবী, চেঁচাচ্ছেন কেন?
মা : তুমি অকাম-কুকাম করবে আর আস্তে কথা বলব আমি? তুমি পেয়েছ কী?
ছোট চাচা : চিৎকার করে লাভ তো কিছু হচ্ছে না।
মা: এর মধ্যে লাভ-লোকসান কি? তুমি বৌ থাকতে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে বসে আছ। সেই বৌ এখন যায় তখন যায়।
ছোট চাচা : বিয়ের কথা কোত্থেকে এল? কি মুশকিল। ভাবী প্লিজ, চেঁচাবেন না।
মা : চেঁচাব না মানে? চেঁচানির তুমি দেখেছ কী? দরকার হলে গোটা ঢাকা শহর আমি ঢোল দিব। মাইক ভাড়া করব।
ছোট চাচা; করুন আপনার যা ইচ্ছে।
রঙ্গমঞ্চ থেকে ছোট চাচা প্রস্থান করলেন। মা খানিকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর সিঁড়ি ভেঙে থপথপ করে উঠে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে জমিদার-গিন্নীদের গলায় বললেন, শুনেছি কিছু?
আমি বললাম, না। কি ব্যাপার?
তোর ছোট চাচা ঐ নার্স ব্যাটিকে বিয়ে করে ফেলেছে। তুই যা বলেছিস তাই।
মা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। দম নিচ্ছেন। চিৎকার করে দম ফুরিয়ে গেছে। মার দম ফিরে এলে তিনি টানা গলায় বললেন, আমার মনে হয় ঘটনাটা অন্য। ঘটনাটা অন্য মানে? এমন কিছু একটা হয়েছে যে বিয়ে না করে উপায় নেই। প্ৰেম-ফ্ৰেম কিছু না।
আমি মার বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলাম। মাঝে মাঝে মা এমন বুদ্ধির ঝিলিক দেখান। উদাহরণ দেই। অরুণানামে মীরার এক বান্ধবী আছে। কলেজের বান্ধবী। প্রায়ই টেলিফোন করে। প্রথমে সে চায় আমার মাকে। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে। কেমন আছেন খালামা? আজ কী রান্না করেছেন? তারপর তার গল্প শুরু হয় মীরার সঙ্গে। সেই গল্প আর শেষ হতে চায় না। একদিন এরকম গল্প চলছে, মা এসে ফট করে মীরার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে কানে ধরলেন। ওপাশ থেকে মিষ্টি মিষ্টি গলায়। একটা ছেলে কথা বলছে। মা টেলিফোন রেখে বজ্ৰকণ্ঠে বললেন, মীরা। এ হারামজাদা কে? কে এই হারামজাদা? আর অরুণাইবা কে?
মীরা ছুটে পালিয়ে গেল। আমরা মীরার কাণ্ডকারখানায় হলাম বিস্মিত, মার বুদ্ধি দেখে হলাম চমৎকৃত। মীরা অবশ্যি কিছুদিন বেশ যন্ত্রণা দিল। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। আমাদের কাজের ছেলেকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়ে দশটা ঘুমের ট্যাবলেটও কিনে আনল। মা শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, ঠিক আছে, ঐ ছেলের সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব। বি.এটা পাস করুক।
ঐ ছেলে বি.এ পরীক্ষায় কম্পার্টমেন্টাল পেয়ে যাওয়ায় আমাদের অ হয়ে গেল। মীরার প্রেম বাতাসে উড়ে গেল। কম্পার্টমেন্টাল পাওয়া ছেলেদের প্রতি মেয়েদের প্রেম থাকে না।