বারান্দা থেকে আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম। উপরে উঠার সিঁড়ি এই ঘরেই। বাইরে দিয়েও একটা সিঁড়ি আছে। সিঁড়ির মুখের কলাপসেবল গেট অবশ্যি সব সময় তালাবন্ধ থাকে। খাবার ঘরে পা দেয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মীরাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। আমি বললাম, দোতলায় কিছু হচ্ছে নাকিরে?
মীরাকে কোনো প্রশ্ন করলে কখনো তার সরাসরি জবাব দেয় না। সে বলল, কিছু হবার কথা নাকি?
ছোট চাচীর শরীর ভালো তো?
আমি কী করে বলব, আমি কি ডাক্তার?
মীরার কথাবার্তা থেকে ধরে নেয়া যায় যে, ছোট চাচী ভালেই আছেন। সন্ধ্যার। ঠিক মুখোমুখি একতলা যে পুরো খালি তার পেছনে কোনো কারণ নেই।
আমি মীরার পেছনে পেছনে রান্নাঘর পর্যন্ত এলাম। সে চা বানাতে যাচ্ছে বোধহয়। পরীক্ষার সময় মীরার খুব ঘন ঘন চা খেতে হয়। সে আবার অন্যের বানানট চা খেতে পারে না। বার বার নিজেই বানায়।
বসার ঘরে একটা সন্ন্যাসী বসে আছে, দেখেছিস নাকি মীরা?
হুঁ।
ব্যাটা কে?
ভোলাবাবু।
ভোলাবাবু এখানে কী চায়?
জানি না কী চায়। বড় চাচার কাছে আসে। গুজ গুজ করে কী সব বলে।
চা বানাচ্ছিস নাকি?
হুঁ।
আমাকে এককাপ দিতে পারবি?
না।
মীরা চলায় কেতলি চাপিয়ে মেপে এককাপ চায়ের পানি দিল, এর পরেও রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে দেখাতে হবে যে মীরার এই ব্যবহারে আমি মোটেই আহত হই নি।
তোর পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?
যে রকম হবার সে রকমই হচ্ছে।
তুই কি স্বাভাবিকভাবে কোনো কথাই বলতে পারি না?
না।
মা কোথায়?
জানি না। বাসায় নেই, কোথায় যেন গেছে।
আমি বসার ঘরে চলে এলাম। তিনতলায় উঠা আপাতত স্থগিত। মার সঙ্গে কথা বলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারপর যা হয় করা যাবে। এই সময়টা বরং সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলা যাক।
সন্ন্যাসী এখনো কান চুলকাচ্ছেন। এদের মতো মানুষও তাহলে জাগতিক আনন্দে অভিভূত হন? আশ্চর্য।
আপনার দেয়াশলাই-এর কাজ শেষ হয়েছে?
হয়েছে। নেন ভাইয়া।
কত দিন ধরে আপনি সন্ন্যাসী
জন্ম থেকেই। গেরুয়া ধরলাম ছয় বছর আগে। তার আগে নাঙ্গা বাবার শিষ্য ছিলাম কাপড় ছাড়া।
পুরো দিগম্বর? না নেংটি-ফেংটি ছিল?
কিছুই ছিল না।
লজ্জা করত না?
প্রথমে দুই একদিন করল, তারপর দেখি আর করে না। নাঙ্গা থাকলে শরীরটা ভালো থাকে। অসুখ-বিসুখ হয় না। যে একবছর নাঙ্গা ছিলাম জ্বর-জারি, সর্দি-কাশি কিছুই হয় নাই।
নাঙ্গা থাকলেই পারতেন, কাপড় ধরলেন কেন?
ঠিকই বলেছেন, আবার নাঙ্গা হতে ইচ্ছা করে। কাপড় গায়ে কুটকুট করে, সহ হয় না।
মীরা দরজার পর্দা ধরে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলল, দাদা, চা নিয়ে যা। আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম। মীরা তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি শেষ পর্যন্ত করুণা করবে, এটা মনে হয় নি।
শুধু আমার জন্যে আনলি? সন্ন্যাসী ব্যাটার জন্যে আনলি না? ওকে সামনে রেখে খাব?
ও এই বাড়িতে কিছু খায় না।
তাই নাকি? কারণ কি?
জানি না।
আমি চা নিয়ে সন্ন্যাসীর সামনে বসলাম। সে এখন অতি দ্রুত পা নাচাচ্ছে। কিছু কিছু মানুষ পা নাচানোর এই ব্যাপারটা অতি দ্রুত করতে পারে।
আপনি শুনলাম এই বাড়িতে কিছু খান না।
ঠিকই শুনেছেন।
কারণ জানতে পারি?
যেসব বাড়িতে পাপকার্য হয়, সেসব বাড়িতে আমি খাদ্য গ্রহণ করি না।
এই বাড়িতে পাপকার্য হয়?
হুঁ, হয়।
ফাজলামি করছেন নাকি?
না।
আমার তো মনে হয় করছেন।
না। করছি না। আমি সন্ন্যাসী মানুষ। ফাজলামি করব কেন?
প্ৰচণ্ড একটা ধমক দেব দেব করেও শেষ পর্যন্ত দিলাম না। ধমকা-ধমকি আমার স্বভাবে নেই। ব্যাটা যদি মনে করে এই বাড়িতে প্রচুর পাপকার্য হয় তাহলে মনে করুক, কিছুই যায় আসে না।
কী ধরনের পাপকার্য এ বাড়িতে হচ্ছে?
তা তো আপনারাই ভালো জানেন।
জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।
সন্ন্যাসীর কিছু বলার সুযোগ হল না। বড় চাচা ঢুকলেন। তাঁর হাতে বাজারের দুটো প্ৰকাণ্ড থলি। বড় চাচার পেছনে মা। মার পেছনে ইরা। এই প্রসেশন-এর অর্থ হল—আজ বুধবার, সাপ্তাহিক বাজারের দিন। সাপ্তাহিক বাজার চাচা নিজে করেন এবং বেশ আগ্রহ নিয়ে করেন। সেই দিন তাঁর সঙ্গে দু তিন জন থাকতে হয়। যাদের কাজ হচ্ছে তাঁর পেছনে পেছনে ঘোরা এবং যখনই তিনি কিছু কেনেন তখন বলা—জিনিসটা সস্তায় কেনা হয়েছে।
বড় চাচা সন্ন্যাসীকে দেখে বিরক্তমুখে বললেন, আজ আপনি এসেছেন কেন? আপনাকে বলেছি না বুধবারে কখন আসবেন না। সেটা বলার পরেও দেখি প্ৰতি বুধবার এসে বসে থাকেন। এর মানে কি?
দিনক্ষণ আমার খেয়াল থাকে না স্যার। গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীর মুখে স্যার শব্দটা একেবারেই মানায় না। সন্ন্যাসীর মধ্যেও আজকাল সম্ভবত ভেজাল ঢুকে গেছে।
স্যার, আমি কী চলে যাব?
হুঁ, চলে যান। বুধবারে কখন আসবেন না। নেভার।
আচ্ছা। বুধবার বাদ দিয়েই আসব। আমি সন্ন্যাসী মানুষ। আমার কাছে বুধবারও যা, বৃহস্পতিবারও তা। সব সমান।
যখন-তখন আসারও দরকার নেই। আমি খবর পাঠালে তবেই আসবেন?
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম! সবে বাজার এসেছে। দুটোর আগে আজ খাওয়াদাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া যেতে পারে।
আগেই বলেছি, আমার ঘর তেতলার ছাদে। এটাকে ঘর বলাটা ঠিক হবে না। জিনিসপত্র রাখার জন্যে চিলেকোঠার মত একটা জায়গা আছে, যার ছাদ করোগেটেড টিনের। দিনের বেলা এখানে ঢোকা যায় না। গরমে টিন তেতে থাকে। তবে রাত আটটা নটার পর খুব আরাম। একটাই অসুবিধা-জানালা নেই বলে দরজা খুলে রাখতে হয়। রোজই ঘুমুবার সময় একটু ভয় ভয় লাগে। যদি ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে যাই। আমাদের তেতলার ছাদে এখনও রেলিং হয় নি। বর্ষার সময় ছাদ খুব পিচ্ছিল হয়ে থাকে।