বাবা খাওয়া রেখে উঠে চলে গেল। ঘটনা এখানেও শেষ হল না। মা মরিয়মকে ডেকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বাবা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। মা মরিয়মকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে বললেন, এইবার মনের সাধ মিটিয়ে ফষ্টিনষ্টি কর। এই বলেই তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এসে ঘরে তালা লাগিয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটা ঘটল আমার চোখের সামনে।
রিমি কাঁদতে শুরু করল। সে চিৎকার করে কাঁদবে বলেছিল। সত্যি সত্যি সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
সে কাঁদবে না—আমার এই ধারণা ঠিক হল না। যতটুকু অবাক হবার দরকার আমি তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম। আমার নিজের ধারণার বাইরে যখন কিছু ঘটে, তখন খুব অবাক হই। কারণ সচরাচর তেমন ঘটে না।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে—এই দৃশ্য চুপচাপ দেখা যায় না। আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে মাথায় হাত দিতেই সে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, গায়ে হাত দিচ্ছিস কেন স্টুপিড? মেয়েদের গায়ে হাত দিতে ভাল লাগে?
খালার বাড়িতে অল্পকিছু সময় থাকব বলে এসেছিলাম। থাকতে হল রাত দশটা পর্যন্ত। মরা-বাড়ির শতেক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হল। ট্রাক আনা, গোরস্থানে খোঁজখবর করা।
এর মধ্যে একবার মেজো খালুর বড় ভাই আবার একটা এক শ টাকার নোট দিয়ে বললেন, টুকু, চট করে এক প্যাকেট বিদেশি ফাইভ ফাইভ নিয়ে আয় তো।
আমি উদাস গলায় বললাম, আমাকে দোকানদাররা খুব ঠকায়, পাঁচ দশ টাকা। বেশি নেবে, অন্য কাউকে দিয়ে আনালে হয় না?
আর কাউকে দেখছি না। তুই কাইন্ডলি যা।
আমি চকচকে এক শ টাকার নোটটা নিয়ে বের হয়ে এলাম। মনে হল আর ফিরে না গেলে কেমন হয়? ব্যাটাকে সামান্য শিক্ষা দেয়া। সে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হবে। টাকা যাওয়ার শোকে পাথর হয়ে যাবে। হোক। অবশ্যি আমার কপালে চোর অপবাদ জুটবে। জুটুক। কী আর করা। বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এতক্ষণ যখন ছিলাম, মৃত মানুষটাকে কবরে শোয়ানো পর্যন্ত থেকে যাই। আমি সিগারেটের বদলে তিন কেজি চিনি কিনে ফেললাম।
কই, সিগারেট এনেছ? দাও।
আমি বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বললাম, সিগারেট আনতে বলেছিলেন না কি? মাই গড। আমি তো আবার তিন কেজি চিনি নিয়ে এসেছি।
মেজো খালুর সাজুগুজু করা ভাই হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, রাগে তাঁর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
আমি বদলে নিয়ে আসছি। আপনি চিন্তা করবেনো। ঐ দোকানেসিগারেটও আছে। ইন দি মিন টাইম আপনার যদি খুব সিগারেটের তৃষ্ণা হয় আমার কাছ থেকে একটা নিয়ে খেতে পারেন।
তুমি বদলে নিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা।
আমি ঠিক করে ফেললাম আধঘণ্টার মতো হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যাব। খুব ভালোমানুষের মতো গলায় বলব, ফেরত নিল না। অনেক চেষ্টা করেছি। সোসাইটিটা নষ্ট হয়ে গেছে। কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।
সেলুনে চুল কাটাতে
সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলাম।
ফিরে এসে দেখি এক জন সন্ন্যাসী বসে আছেন। সোফায় পা তুলে পদ্মসন হয়ে বসে থাকা জলজ্যান্ত সন্ন্যাসী। বাংলাদেশে এই জিনিস দেখাই যায় না। যে দু একটা দেখা যায় তাও স্কুলের এ্যানুয়েল স্পাের্টসে যেমন খুশি সাজো অংশে। কিন্তু যে সন্ন্যাসী বসে আছেন তাঁর মধ্যে সাজের কোনো ব্যাপার নেই, খাঁটি সন্ন্যাসী। চুলে জট, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গেরুয়া কাপড়। সোফায় হেলান দেয়া বিচিত্র এক লাঠি। সন্ন্যাসী আমাকে বললেন, ভাইয়া, আপনার কাছে দেয়াশলাই আছে?
সন্ন্যাসীর মুখে ভাইয়া ডাক মানায় না। ওহে বৎস-টৎস বললে হয়ত মানাতো। আমি তাঁকে দেয়াশলাই দিলাম। ভেবেছিলাম তিনি সিগারেট ধরবেন, তা না করে তিনি দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে গভীর মনোযোগ কান চুলকাতে লাগলেন। কান চুলকানোর মতো শারীরিক সুখের প্রতি সন্ন্যাসীদের মোহ থাকে জানতাম না। আমি বেশ কৌতূহল নিয়েই তাকিয়ে রইলাম।
এর আগমন কী জন্যে হয়েছে কে জানে। সম্ভবত চাচীর অসুখ সারানোর জন্যে। সব কিছুই তো হল, সন্ন্যাসীই বা বাদ থাকে কেন?
আমি বললাম, আপনি এখানে, কি ব্যাপার? সন্ন্যাসী জবাব দিলেন না। ব্যাপার কি জানার জন্যে বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।
আমাদের বসার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোট ঘরটায় আমার হোট দুবোন মীরা এবংনীরা পড়ে। দুজনেরই সামনে পরীক্ষা। এই সময় এদের বই চোখের সামনে নিয়ে বসে থাকার কথা। আজ কেউ নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, শুধু এরাই যে নেই তাই না, পুরো একতলায় কোনো মানুষজন নেই। লক্ষণ মোটই সুবিধার নয়। মনে হচ্ছে ছোট চাচীর কিছু একটা হয়ে গেছে। কিংবা হতে যাচ্ছে। সবাই ভিড় করেছে দোতলায়। ফলস্ এ্যালার্ম কি কে জানে। ইদানীং মাসের মধ্যে দু একবার ছোট চাচী ফলস্ এ্যালার্ম দিচ্ছেন। মরি মরি করেও মরছেন না।
আমি ভেতরের দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। দোতলায় যাব? না এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। আমার ঘর তিনতলার ছাদে। চুপি চুপি নিজের ঘরে চলে যাওয়া যায়। তবে তারও সমস্যা আছে। ভাত খাওয়ার জন্যে আবার একতলায় নেমে আসতে হবে। এই বাড়ির রান্না এবং খাবার ঘর একতলায়, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্যে তিনতলা এবং দোতলায় খাবার যায়, যেমন বড় চাচা তিনতলায় থাকেন, তাঁর জন্যে খাবার যায়। ছোট চাচা থাকেন দোতলায়, তাঁর জন্যেও যায়, তবে সব দিন না। বেশিরভাগ সময়ই তিনি নিচে খেতে আসেন।