আমি তিন কেজি চিনির প্যাকেট নিয়ে খানিকটা দিশাহারার মত হয়ে গেলাম। কাকে দেব? বাড়ি গিজ গিজ করছে মানুষে। সবাই কথা বলছে। মেয়ে মহলের তিনভাগের একভাগ শব্দ করে কাঁদছে। কয়েকজন মৌলানাকে আনা হয়েছে, যারা অতি দ্রুত কোরান খতম দিচ্ছেন। থার্টি থ্রি আরপিএম-এর রেকর্ড ফোৰ্টি ফাইভে দেয়া। হয়েছে। এই বিরাট ঝামেলায় তিন কেজির প্যাকেট দেব কাকে?
খালুর বড় ভাইকে পাওয়া গেল। তিনি লাল টাই খুলে ফেলেছেন। তাঁকে সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখাচ্ছে। সামান্য একটা টাই যে মানুষকে এতটা বদলে দিতে পারে, আমার জানা ছিল না। লাল রঙের কাপড়ের টুকরাটার উপর আমার ভক্তি হল।
চিনি এনেছ টুকু?
জ্বি।
গুড। মেনি থেংকস। ফেরত এসেছে কত?
ফেরত আসে নি। পঁয়ত্রিশ টাকা করে কেজি।
কি বলছ তুমি। ত্রিশ টাকা কেজি সব জায়গায়। দশ টাকা ফেরত আসার কথা!
ভদ্রলোক বিচিত্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। যে দৃষ্টির অর্থ হচ্ছে–দশটা টাকা তুমি ম্যানেজ করে নিলে এটা তো তোমার কাছ থেকে আশা করি নি।
তিনি বিরস মুখে বললেন, টেবিলের উপর রেখে দাও। আমি টেবিলের উপর প্যাকেটটা রাখলাম। ছোট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় মেজো খালাকে আনা হয়েছে। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মেজো খালার অজ্ঞান হওয়া তেমন কোনো বিশেষ ব্যাপার না। অতি সামান্য ব্যাপারেই তিনি অজ্ঞান হন। আমাদের বাসায় এসে একবার তিনি গরমে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর তাঁর জ্ঞান হল এবং তিনি বললেন, এয়ারকন্ডিশন ঘরে থেকে থেকে শরীরের সিস্টেমটাই নষ্ট হয়েছে। ঐ দিন গাউছিয়ায় গিয়েছিলাম, গরমে আর ভিড়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। এক শাড়ির দোকানে নিয়ে শোয়াল। বিশ্রী কাণ্ডআমার হোট বোন মীরার ধারণা, মেজো খালার অজ্ঞানের ব্যাপারটা চমৎকার একটা অভিনয়-কলা। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এই অভিনয় তিনি প্রায় জায়গাতেই করেন এবং বেশ ভালোই করেন। এখানেও তাই বোধহয় হচ্ছে। মেজো খালার মাথায় পানি ঢালছে তাঁদের একমাত্র মেয়ে রিমি। রিমি তার মায়ের মতো রূপবতী হয় নি। খুবই সাদামাঠা ধরনের চেহারা, তবে এই মেয়েকে দেখলেই মনে একটা স্নিগ্ধ ভাব হয়। মনে হয় সে এইমাত্ৰ স্নান সেরে এসেছে। তার গলার স্বরও বেশ অদ্ভুত। যখন কথা বলে তখন মনে হয় অনেক দূর থেকে কথা বলছে। খুব কাছাকাছি থাকলেও তার গলার স্বরের জন্যে তাকে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। রিমি আমার সমবয়েসী। বয়সে আমার তিন মাসের বড়। সে ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স ফাইনাল দেবে। যদিও তার থাকার কথা এম. এ ক্লাসে। সেশন জট সব গুবলেট করে ফেলেছে। মেজো খালা চোখ খুললেন। রিমি পানি ঢালা বন্ধ করে উঠে এল। আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, টুকু, আমার সঙ্গে একটু আয় তো।
রিমির সঙ্গে আমার সম্পর্কে খানিকটা জটিলতা আছে। এই জটিলতার ব্যাপারটা পরে বলব।
রিমি আমাকে তার ঘরে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকিয়েই দরজা ভিড়িয়ে দিল। এটা সে সব সময় করে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় হয় দরজা ভিড়িয়ে দেয়, নয় ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মেজো খালা এই ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই খুব অপছন্দ করেন। মেয়ের সঙ্গে এই নিয়ে তার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। খালা অপছন্দ করেন বলেই রিমি এই কাজটা বেশি বেশি করে।
টুকু, চেয়ার টেনে বস।
আমি বসলাম। রিমি বলল, অসম্ভব কান্না পাচ্ছে। আমি এখন চিৎকার করে কাঁদব। তুই চুপচাপ বসে থাকবি।
আমি কিছু বললাম না। বসে রইলাম। রিমিকে দেখলে মনে হয় সে খুব গোছালো ধরনের মেয়ে। আসলে তা নয়। তার ঘর সব সময়ই এলোমেলো। রিমি কাঁদল না। আমি জানতাম সে কাঁদবে না। আমি এখন কাঁদব বলার পর কেউ কাঁদতে পারে না।
টুকু।
কি।
মার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে অন্য যে কোনো একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে বাবা আরো অনেক দিন বাচত।
এখন এসব কথা থাক।
আমি এই কথা শুধু আজই বলব, আর কোনোদিন বলব না। আর বলব শুধু তোকে, আর কাউকে না।
আমাকে বলার কোনো প্ৰয়োজন দেখছি না।
কথা বলিস না। তুই শুধু শোনে যা। হা হু কিছু করতে হবে না। শুধু শুনে যাবি আমার মা, বাবার জীবনটা একেবারে ভাজা ভাজা করে ফেলেছে। আমি যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখনকার একটা ঘটনা বললেই তুই সবটা বুঝতে পারবি।
আমার বুঝে দরকারটা কি?
কেন শুধু কথা বলছিস? শুনতে অসুবিধা কি? আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, মরিয়ম নামের অল্পবয়েসী একটা কাজের মেয়ে ছিল। মেয়েটা দেখতে বেশ ভালো। একদিন রাতে আমরা সবাই খেতে বসেছি, বাবা বললেন, মরিয়ম, ফ্রিজ থেকে খুব ঠাণ্ডা একগ্লাস পানি দাও তো।
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সব কাজের লোককে তুমি তুই তুই করে বল; মরিয়মকে তুমি করে বলছ কেন?
বাবা বিব্রত সুরে কী যেন বললেন। মা কঠিন গলায় বললেন, ওর সঙ্গে এত কী তোমার খাতির?
খাতিরের কী দেখলে?
ঐ দিন দেয়াশলাইয়ের খোঁজে তুমি রান্নাঘরে গেলে। দেয়াশলাইয়ের জন্যে কেন? দেয়াশলাই আনতে বললে কি ওরা এনে দিত না?
মেয়ের সামনে কী সব পাগলামি শুরু করলে?
সত্যি কথা বললে পাগলামি হয়ে যায়? তুমি আমাকে কী ভাব? আমি চোখেও দেখি না, কানেও শুনি না? তোমার ফষ্টিনষ্টি, ছোঁক ছোঁক আমি বুঝি না? আমি এখনও ফিডার দিয়ে দুধ খাই?