নীল কুঠির মেজো খালুর নিজের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি। উত্তর শাহজাহানপুরে তিনি চমৎকার একতলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন। এ মাসের শেষ শুক্রবারে তাঁদের নিজ বাড়িতে উঠার কথা ছিল। মেজো খালু সে সুযোগ পেলেন না। তাঁদের বাড়ির সবাই দীর্ঘদিন এই নিয়ে বলাবলি করবে। মেজো খালুর প্রসঙ্গ উঠলেই বলবে, আহা, বেচারা নিজের বাড়িতে একরাত কাটাতে পারল না। কী ক্ষতি হতত কয়েকটা দিন পরে মারা গেলো যেন আর কটা দিন পরে মারা গেলে এই মৃত্যু সহনীয় হত।
আমি লক্ষ করেছি সব মৃত মানুষকে নিয়ে একটানা-একটা অতৃপ্তির গল্প চালু থাকে। কেউ হয়তো মৃত্যুর আগের দিন বলেছিল, মা। খুব ঝাল দিয়ে পাবদা মাছ রাধ তো। খেতে ইচ্ছা করছে। মা রাঁধেন নি। এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। আজ তিনি শুধু পাবদা মাছ না, কোনো মাছই খেতে পারেন না।
মৃত লোকের চেয়ে তার অতৃপ্তির ব্যাপারটি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। মৃত মানুষটির কথা কেউ বলে না। তার অপূর্ণ সাধের গল্প করে। আচ্ছা, এমন কেউ কি আছে মৃত্যু। মুহূর্তে যার কোনো অপূর্ণ সাধ ছিল না? যে যাত্রা শুরু করে একজন পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত এবং সুখি মানুষ হিসেবে?
আমি দাঁড়িয়ে আছি নীল কুঠিরের গেটের বাইরে। আমার মনে উচ্চ শ্রেণীর সব ভাব আসছে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। সকালের সিগারেটটি খাওয়া হয় নি। সিগারেট ধরাবার একটা চমৎকার জায়গা। সিগারেট ধরালাম। এবং সুখ কী এই নিয়ে চিন্তা শুরু করলাম। এইসব চিন্তা-ভাবনার বুদ্ধি বড় চাচার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি আমাদের আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে এ জাতীয় ট্রেনিং ছেলেবেলায় দিয়েছেন—বুঝলি, যখন কিছু করার থাকবে না তখন চিন্তা শুরু করবি। ধর, সুন্দর একটা গাছ দেখলি, তখন কী করবি? নিজেকে প্রশ্ন করবি-গাছটা সুন্দর লাগছে কেন? সৌন্দর্য ব্যাপারটা কী?
বড় চাচার ট্রেনিঙে আমাদের আত্মার শক্তির কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে কি-না আমি জানি না তবে খানিকটা ভ্যাবার মতো যে হয়েছি তাতে সন্দেহ নেই।
কে, টুকু না?
ফিলসফিক চিন্তা-ভাবনা থেকে সরাসরি ধুলা-কাদার পৃথিবীতে চলে এলাম। প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। যিনি প্রশ্ন করছেন তিনি মেজো খালুর বড় ভাই। পর্যটনের বড় অফিসার। পর্যটনের অফিসাররা সব সময় খানিকটা সেজেগুজে থাকেন। তাঁদের দেখলেই মনে হয় এই বুঝি বেড়াতে যাচ্ছে। হয় পিকনিকে, নয় বিয়েবাড়িতে। এই ভদ্রলোক নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও লাল টকটকে একটা টাই পরে এসেছেন। জুতা যেমন চকচক করছে, তাতে মনে হয় বুট পালিশওয়ালাকে দিয়ে পালিশ করানো। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা। এঁর সঙ্গে আমার এমন কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই যে তিনি আমাকে তুই তুই করে বলবেন। আমি লক্ষ করেছি, আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজন (নিকট কি দূরের) আমাকে তুই তুই করে বলেন এবং দেখা হওয়ামাত্র কোন একটা ফরমায়েস দিয়ে বসেন। সম্ভবত আমার চেহারায় চাকর চাকর একটা ভাব আছে।
মেজো খালুর বড় ভাই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, তিনি এখন বলবেন—চট করে এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে আয় তো দেখবি যেন ড্যাম্প না হয়। সত্যি সত্যি ভদ্রলোক একটা এক শ টাকার নোট বের করে ইতস্তত করতে লাগলেন। আমি বললাম, কিছু আনতে হবে?
তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, তিন কেজি চিনি নিয়ে আয় তো। ঘরে এক দানা চিনি নেই, এদিকে লোকজন যারা আসছে, তাদের এটলিস্ট এককাপ চা তো অফার করা দরকার। এর নাম সামাজিকতা। মরেও রক্ষা নেই, সামাজিকতা চালিয়ে যেতে হবে। হোয়াট এ সোসাইটি।
তিন কেজি চিনি কিনলাম। পঁয়ত্রিশ টাকা করে তিন কেজির দাম নিল এক শ পাঁচ টাকা। আমি দোকানদারকে বললাম, আমার কাছে এক শ টাকাই আছে। আপনি কি পাঁচটা টাকা কম রাখতে পারেন?
দোকানদার বলল, একদাম। এমনভাবে বলল যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পাঁচ টাকা কমানোর প্রস্তাবে সে খুবই অপমানিত বোধ করছে। আমি বললাম, আপনি এক কাজ করুন, এখান থেকে পাঁচ টাকার চিনি কমিয়ে ফেলুন। দুই খাবলা চিনি নিয়ে নিন। দোকানদার মনে হল এতে আরো অপমানিত বোধ করল। এক ধরনের মানুষই আছে যারা কথায় কথায় অপমানিত বোধ করে। এদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—ভাই কেমন আছেন? এরা অপমানে নীল হয়ে যায়। মনে করে, তাদের দারুণ অপমান করা হল। এই দোকানদার বোধহয় সেই পদের। সে চিনি কমাল না। প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে মুখঝামটার মতো একটা ব্যাপার করল। যেন তার পাঁচ লক্ষ টাকা লোকসান হয়ে গেছে। আমি মনে মনে হারামজাদা বলে বের হয়ে এলাম।
মা-বাড়ির দৃশ্য সচরাচর যা হয়, এ বাড়িতেও তাই। মেজো খালা কাত হয়ে একটা ইজিচেয়ারে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু একজন কে যেন প্রবল বেগে তালপাতার পাখায় তাকে বাতাস করছে। খালার মাথার সমস্ত চুল ভেজা। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই মাথা ধুইয়ে দেয়া হয়েছে। পরিচিত যে-ই আসছে, খালা খানিকক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন এবং বলছেন, আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমরা আমাকে বিষ এনে দাও। আমি সহ্য করতে পারছি না।
আমার চট করে মনে হল খালাকে খানিকটা বিষ সত্যি সত্যি যদি এখন দেয়া হয় এবং বলা হয়—এই যে বিষ এনেছি, নিন। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? খালা এই মুহূর্তে প্রবল শোকের যে ছবি দেখাচ্ছেন তার কতটা খাঁটি? আমি নিশ্চিত, মাসখানিকের মধ্যে তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। ভিসিআর-এ ছবি দেখবেন। দুপুরে ঘুবেন। তরকারিতে লবণ কম হলে কাজের মেয়েটিকে বকাঝকা করবেন।