ছোট চাচার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হল। মেয়েটির নাম নিনি। যে সব মেয়ের নিনি জাতীয় নাম হয় তারা সাধারণত খুব হাইফাই ধরনের হয়ে থাকে। ছোট চাচীও তাই। পুতুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে, যাঁর ঠোঁট দুটো লিপিষ্টিক ছাড়া লাল টুকটুকে। বিয়ের ছমাসের মধ্যেই ছোট চাচী কী রোগ বাধালেন কে জানে দিনরাত কু কুঁ। শরীরে তীব্র ব্যথা। সেই ব্যথাও বেশ অদ্ভুত ধরনের, হেঁটে চলে বেড়ায়। কখনো ব্যথাটা হাতে, কখনো পায়ে, কখনো পেটে। আমি এমন অদ্ভুত অসুখ কখনো দেখিনি, কারো হয়েছে বলেও শুনি নি। সব রকম চিকিৎসা হয়েছে, এখন চলছে দ্বৈব চিকিৎসা। ছাগলের মতো দাড়িওয়ালা এক লোক বেতের টুপি মাথায় দিয়ে প্রতি মঙ্গলবার আসছে। ছোট চাচীর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কী সব ঝাড়ফুক নাকি করছে। আলোচনা শুনতে পাচ্ছি চাচীকে আজমীর শরীফে নিয়ে যাওয়া হবে। মনে হচ্ছে, চিকিৎসাশাস্ত্ৰ পুরোপুরি ফেল করেছে। তবে খুব লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এই প্ৰচণ্ড অসুখবিসুখে তাঁর চেহারা বা স্বাস্থ্যের কোনো এদিক-ওদিক হচ্ছে না। আগে যেমন ছিলেন, এখনো তেমনই আছেন। বরং ঠোঁট এবং গাল দুই-ই আরো বেশি লালচে হয়েছে।
নাশতা শেষ করে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দা হল আমার মোকিং কর্নার। বারান্দা এবং ছাদ। বেশিরভাগ লোকই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে সিগারেট টানতে ভালবাসে, আমার ভালো লাগে হেঁটে হেঁটে টানতে। সিগারেট অবশ্যি ধরানো গেল না। জ্বলন্ত সিগারেট চট করে লুকিয়ে ফেলতে হল। কারণ বাইরের বারান্দায় ছোট চাচা বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর সামনে নার্সের পোশাক পরা মিস নমিতা (কিংবা মিস সমিতা, এই মুহূর্তে নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।) এই নার্সটির বয়স খুবই অল্প। চেহারা ভালো না। গায়ের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তবু ধবধবে সাদা নার্সের পোশাকে মেয়েটিকে চমৎকার লাগে। দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মিস নমিতা (অথবা সমিতা) এই বাড়িতে মাঝে মাঝে আসেন। ছোট চাচীর খুব বাড়াবাড়ি হলে তাঁকে আনা হয়। কাল রাতে নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই তাঁকে আনা হয়েছে। নিশ্চয়ই রাত জেগেছে। ঘন ঘন হাই তুলছে। জগতের কুৎসিততম দৃশ্যের একটি হচ্ছে মেয়েদের হাই ভোলা, তবে এই মেয়েটিকে হাই তোলা অবস্থাতে তেমন খারাপ দেখাচ্ছে না।
ছোট চাচা আমাকে দেখেই বললেন, যাচ্ছিস কোথায়?
আমি বললাম, মেজো খালুর বাসায়। বেচারা মারা গেছেন। শুনেছেন বোধহয়।
হুঁ, শুনেছি। আনফরচুনেট ডেথ। আমার একবার যাওয়া উচিত। দেখি বিকেলের দিকে যদি সময় পাই। বিকেলে আবার একটা মিটিং পড়ে গেল।
ছোট চাচা কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। আমার কাছে কৈফিয়ৎ দেবার তো কোন দরকার নেই, তবু দিচ্ছেন কেন কে জানে। তিনি অকারণে খানিকক্ষণ খুক খুকও করলেন। নার্ভাস হলে তিনি এটা করেন। যে কোনো কারণেই হোক তিনি আজ খানিকটা নার্ভাস। আমি বললাম, যাই চাচা। তিনি বললেন, আয়, তোক খানিকটা এগিয়ে দেই। মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত। ওখান থেকে রিকশা নিয়ে যাবি।
গাড়িতে আমরা চার জন উঠলাম। ছোট চাচা ড্রাইভিং সিটে, আমি তাঁর পাশে। পেছনের সিটে সমিতা এবং ড্রাইভার কুদুস মিয়া। ড্রাইভার কুদ্দুস মিয়া এ বাড়িতে খুব সুখের চাকরি করছে। পুরো বেতন নিচ্ছে অথচ গাড়ি চালাতে হচ্ছে না। গাড়ি সব সময় ছোট চাচাই চালান। সে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে পেছনের সিটে বসে বসে ঝিমায়।
গাড়ি বড় রাস্তায় পড়ামাত্র ছোট চাচা বললেন, সমিতা, তুমি কোথায় নামবে?
মেয়েটার নাম তাহলে সমিতা। নমিতা নয়। সমিতা মানে কী? কে জানে।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, সমিতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কেন জবাব দিল না কে জানো প্রশ্ন শুনতে না পেলে ভিন্ন কথা, কিন্তু যদি শুনে থাকে তাহলে জবাব দেবে না কেন? রহস্যটা কী? শাহবাগের মোড়ে এসে ছোট চাচা গাড়ি থামিয়ে বললেন, কুদ্দস, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও তো।
কুদ্দুস নেমে গেল।
কদ্দসের সঙ্গে নামল সমিতা। শীতল গলায় বলল, আমি এইখানে নামব। বলেই গট গট করে চলে গেল। সালাম দিল না বা বলল না, স্যার যাই। এর মানেটা কী? কুদ্দুস সিগারেট কিনেছে কিন্তু ভাংতি দিতে পারছে না। তার হাতে পাঁচ শ টাকার একটা নোট। নোটটা নিয়ে এ-দোকান ও-দোকান করছে।
ছোট চাচা বললেন, টুকু, একটা সমস্যা হয়েছে। তোকে বলা দরকার।
আমি বললাম, কী সমস্যা?
তিনি বেশ সহজ গলায় বললেন, এই সমিতা মেয়েটাকে আমি বিয়ে করব বলে ভাবছি।
আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, কবে?
সেটা এখনো ফাইনাল করি নি। কবে বিয়ে করব সেটা ইম্পৰ্টেন্ট নয়। বিয়ে করব সেটাই ইম্পৰ্টেন্ট।
বলেই ছোট চাচা গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কারণ কুদ্দুস টাকার ভাংতি পেয়েছে। সে সিগারেট নিয়ে ফিরছে। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, বাড়ির কেউ জানে?
না। আমি বলব সবাইকে। লুকিয়ে রাখার মতো তো কিছু না।
ছোট চাচার গাড়ি উড়ে চলল। তিনি আস্তে গাড়ি চালাতে পারেন না। গাড়ি হু হু করে ছুটছে। আমি বসে বসে ঘামছি। কী সর্বনাশের কথা।
মেজো খালুরা একটি দুতলা বাড়ির একতলায় থাকেন। বাড়ির নাম নীল কুঠির। অবশ্যি কুটির বানানটা ভুল করে লেখা কুঠীর। ভুল নামের বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় এই বাড়িতে ঝামেলা আছে।