ভোলাবাবু কৰ্দমস্নানের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। আমরা সবাই মোটামুটি খানিকটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। যেদিন কর্দমমান হবে তার আগের দিন বড় চাচার ছোট মেয়েটার চিঠি এসে উপস্থিত। দীর্ঘ চিঠি। পুরো চিঠি ইংরেজিতে লেখা। বাংলা অনুবাদ অনেকটা এরকম হবে–
বাবা,
আমার আদর ও ভালবাসা নাও। গত পরশু মা এসে পৌঁছেছেন। তাঁর কাছে শুনলাম, তোমার শরীর ভালো না। তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে মা চলে আসবেন, কল্পনাও করি নি। তোমরাই বা কী মনে করে তাঁকে ছাড়লে?
আমার এখানে এসে তিনি নানান রকমের সমস্যার সৃষ্টি করেন। যেমন সবার সব ব্যাপারে নাক গলানো। যেখানে তাঁর কথা বলার কিছু নেই, সেখানেও তিনি কথা বলবেন। যা শোর না তাও তিনি শুনবেন। আমি আমার বরের সঙ্গে কী কথা বলছি, তা শোনার জন্যে আড়ি পাবেন।
আমি জানি এসব তিনি করেছেন আমার মঙ্গলের জন্য। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এতে তেমন কোনো মঙ্গল হচ্ছে না। বরং অমঙ্গল হচ্ছে। তোমাদের জামাই পুরো ব্যাপারটায় খুব সঙ্গত কারণেই বিরক্ত হচ্ছে। তোমাকে আমি জানাতে চাই নি। তবু বাধ্য হয়ে জানাচ্ছি মা গত বছর হিউম্যান রাইটস এবং দেশের নারী সংঘের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন যে, আমার স্বামী আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। কী ভয়াবহ কথা চিন্তা করে দেখ। সেখান থেকে তদন্তের জন্যে লোক এসে উপস্থিত।
তোমাদের জামাই লজ্জায় এবং দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে গেছে। সব পরিবারেই ঝগড়া হয়। ও যেমন চিৎকার করে, আমিও করি। এর মানে নারী নির্যাতন নয়। আমরা সুখেই আছি। ছোটখাট সমস্যা আমাদের অবশ্য আছে। তবে তা আমরা নিজেরাই দূর করব। মার হস্তক্ষেপ ছাড়াই করব।
মাকে আমরা দেশে ফেরত পাঠাতে চাই। তোমার চিকিৎসা ও সেবা-যত্নের জন্যেও তাঁর থাকা দরকার। আমরা খুব চেষ্টা করছি দ্রুত মার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। বাবা, এই চিঠির বিষয়বস্তু মা না জানলে ভালো হয়। জানলে তিনি কষ্ট পাবেন।
বড় চাচার কর্দমস্নান শুরু হল।
বেশ উত্তেজক দৃশ্য। লরেটা পর্যন্ত স্কুলে যায় নি। আমার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।
বড় চাচাকে একটি চাটাইয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার পাশে মাটির গামলা ভর্তি কাদা ভোলাবাবু ডাল ঘোঁটার ঘুঁটনিতে প্রবল বেগে কাদা খুঁটছেন। কাদা মন্থর করে মাখনের মতো কিছু তুলতে চান কিনা কে জানে।
মীরা বলল, সন্ন্যাসী চাচা, এরকম করছেন কেন?
ভোলাবাবু মধুর স্বরে বললেন, কাদা মিহি বানাচ্ছি মা জননী। তাই নিয়ম।
ভোলাবাবু আমাকে ভাই ডাকলেও মীরাকে মা ডাকেন। আর মাকেও মা ডাকেন। বেলানটার দিকে ভোলাবাবুবললেন, এইবার কর্দমস্নান শুরু হবে। নটা পাঁচ মিনিটে লগ্ন শুভ। যদিও কেউ ছবি তুলতে চান ছবি তুলেন।
ঘরে ফিল্ম ছিল না একজন দৌড়ে গিয়ে ফিল্ম আনল। সেই ফিল্মে ছবি তোলা হল।
কর্দমমানের ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। স্নান শেষ হবার পর গোসল দেয়া হল। গোসলের পর দেখা গেল বড় চাচার শরীরের বাঁ অংশটাও এখন অচল। পুরো প্যারালিসিস।
ভোলাবাবু শীতল গলায় বললেন, সবই ভগবানের লীলা! আমাকে গরম এককাপ চা দিতে বলুন তো। কাদা ঘেঁটে ঠাণ্ডা লেগে গেছে।
মজার একটা খবর পাওয়া গেল
সকাল দশটায় মজার একটা খবর পাওয়া গেল। খবরটা হল–রিমির মা ফরিদা খালা বিয়ে করেছেন। ভদ্রলোকের নাম সেলিম। বিয়েটা কয়েকদিন আগেই হয়েছে। খবর পাওয়া গেল আজ। বাইরের কারো মুখ থেকে খবর পাওয়া গেলে আমরা চট করে বিশ্বাস করতাম না। খবর দিলেন খালা নিজেই। টেলিফোন করে মাকে বললেন, বড় আপা, আপনাকে একটা খবর দিতে চাই। খবর দিতে লজ্জা লাগছে। কে কিভাবে ইন্টারপ্রিট করে কে জানে। আমাদের নেচারই হচ্ছে নেগেটিভ সাইডটা আগে দেখা।
মা বললেন, খবরটা কি?
এই সমাজে মেয়েদের একা থাকা যে কী যন্ত্রণা, তা তো সবাই জানে। মেয়েদের একা থাকা অসম্ভব ব্যাপার। এক জন অভিভাবক লাগেই। তাছাড়া আপা, আপনি তো জানেন না রিমির বাবার দিকের আত্মীয়রা আমাকে কী রকম বিষদৃষ্টিতে দেখে। সারাক্ষণ চেষ্টা কী করে আমাকে ঠকাবে। ঐদিন রিমির মেজো চাচা আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার চাইল। আমি বললাম, এত টাকা আমি পাব কোথায়? এতে রেগেমেগে যেসব কথা বলল; আপনি শুনলে হার্টফেল করবেন।….
খবরটা কী সেটা আগে বল।
আপনি কিছু শোনেন নি?
না।
আমি বিয়ে করেছি বড় আপা। মাথার উপর যেন এক জন অভিভাবক থাকে এই জন্যে করা। রিমিও মত দিয়েছে।
রিমিও মত দিয়েছে?
হ্যাঁ। আসলে ও আমাকে ইনসিস্টও করেছে।
ফরিদা খালা দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। মার স্মৃতিশক্তি তেমন ভালোনা। বেশিরভাগ কথাই তিনি ভুলে যান কিন্তু টেলিফোনের কথোপকথনের পুরোটা তিনি গড় গড় করে আমাদের বললেন। দাঁড়ি-কমাও বাদ দিলেন না। বাড়ির মেয়েদের খুব দুঃখিত মনে হলেও তেমন দুঃখিত হয়ত তারা হল না। তাদের চোখে-মুখে চাপা উল্লাস। বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করে এই খবর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা। দেখা গেল বাসায় প্রায় সবাই জানতো যে এরকম একটা কিছু হবেই। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটাও দেখা গেল সবাই জানে।
মীরার ধারণা, সেলিম নামের এই, লোক ভুজুংভাজুং দিয়ে বাড়িটা নিজের নামে লিখিয়ে নেবে। টাকা-পয়সা হাত করবে। তারপর লাথি দিয়ে স্ত্রীকে খেদিয়ে দেবে।
ইরা অবশ্যি মীরার সঙ্গে একমত হল না। ইরার ধারণা, ফরিদা খালা ঐ লোকটার টাকা-পয়সা সব হাত করবে, তারপর লোকটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবে।