এর মধ্যে মেজো মেয়ের চিঠি পেয়ে চাচী আরো অস্থির হলেন। ওদের না-কি খুব। সমস্যা হচ্ছে। ছোট বাচ্চাটি সিঁড়ি থেকে পা মচকে ফেলেছে। বড় চাচী আমাদের সবাইকে কয়েকবার করে বলে ফেললেন–
আরেকটু হলে হাত-পা ভাঙত। মাথায় চোট পেত। কে জানে হয়ত পেয়েছে, আমাকে জানাচ্ছেনা। আসবার আগে এত করে বলে এলাম সিঁড়িগুলোতে বেড়া লাগিয়ে দিতে, নিশ্চয়ই লাগায় নি। আমেরিকাতে সিঁড়ি আটকানোর জন্যে প্রটেকটিভ ব্যবস্থা আছে। বিশ ত্রিশ ডলারে পাওয়া যায়। বাচ্চারা তখন আর সিঁড়ি ডিঙাতে পারে না। ঐ ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে নি। আর করবেই বা কিভাবে? সে একা মানুষ, কদিক সামলাবে?
আমার মা বড় চাচীকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে মাসখানিক অন্তত থাকেন। এক জন অসুস্থ মানুষকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাওয়া যে অন্যায় এটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। বড় চাচী বললেন, আমি কি বুঝি না? তুমি কি ভাব চলে যাবার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগছে? কিন্তু উপায় কি?
উপায় আছে। ওরা ওদের ব্যবস্থা করবে।
কী করে করবে? দেশে এক জন বিপদে পড়লে দশজন এগিয়ে আসেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবওখানে এইসব কোথায়?
জুন মাসের শেষের দিকের এক বৃহস্পতিবারে বড় চাচীর টিকিট কনফার্ম করা হল। সেই দিনই রাত দশটায় আমি তাঁকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পেলাম। বাসার সামনে একটা বেবিটেক্সি নিয়ে আসা হল।
বড় চাচী বেবিটেক্সি দেখে শুকনো গলায় বললেন, বেবিটেক্সি কেন? গাড়ি কোথায়? গাড়ি কোথায় আমরা কেউই জানি না। ছোট চাচা গাড়ি নিয়ে সেই সকালে বের হয়েছেন, এখনও ফেরেন নি। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন আর্জ বড় চাচীর চলে যাবার দিন।
বড় চাচী বললেন, এয়ারপোর্টে কে কে যাচ্ছে? একটা বেবিটেক্সিতে হবে?
আমি বললাম, হবে, আমি ছাড়া আর কেউ যাবে না।
তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, যাচ্ছে না কেন?
যাবার দরকার কি? এত রাতে খামাকা কষ্ট। গাড়ি থাকলেও একটা কথা ছিল। দেরি করে লাভ নেই, উঠে পড়ুন।
যথারীতি অত্যন্ত করুণ একটা বিদায়-দৃশ্যের অভিনয় হল। তিনি বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। জড়ানো গলায় বললেন ওদের কাছে দুতিন সপ্তাহ থেকে চলে আসব, আর যাব না। ভালো লাগে না। বাকি জীবনটা দেশেই কাটাব। উনারও শরীর খারাপ হয়েছে, সেবাযত্ন দরকার।
বড় চাচীর এ ধরনের কথার কোনোই গুরুত্ব নেই। প্রতিবারেই যাবার সময় এসব বলেন।
এয়ারপোর্টে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসালেন। এমন এক দৃশ্যের অবতারণা হল যে, চারদিকে লোক জমে গেল।
ও টুকু রে, যত ঝামেলা শুধু তোর উপর দিয়ে যায়। তোর জন্যে আমার বড় কষ্ট হয় রে টুকু। দেখি তোর জন্যে কিছু করা যায় কি-না। জামাইকে বললে সে একটা ব্যবস্থা করবে। অনেক কংগ্রেসম্যানকে সে চিনে। ওদের কাছে ইমিগ্রেশনের কথা বললেই করে দেবে। তুই বায়োডাটা পাঠিয়ে দিস।
বাসায় ফিরতে রাত দুটো বাজল। এসে শুনলাম, বড় চাচার অবস্থা খুবই খারাপ। লক্ষণ দেখে মনে হয়, মাইন্ড স্ট্রোক জাতীয় কিছু হয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। খুব ঘাম হচ্ছে। পানির পিপাসা হচ্ছে। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। হাসপাতালে নেবার কথা উঠতে আতঙ্কে অস্থির হচ্ছেন।
অস্পষ্ট গলায় বলছেন, না, না।
পাড়ার ডাক্তার বললেন, হাসপাতালের কথায় ইমোশনালি আপসেট হয়ে যাচ্ছে। এতে আরো খারাপ হবে। আপনারা আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনারা এক জন হাইস্পেশালিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
আমার বাবা খুবই ভীতু ধরনের মানুষ। তিনি থর থর করে কাঁপছেন। প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, বাঁচবে তো ডাক্তার সাহেব?
হ্যাঁ, বাঁচবেন। আমার তো মনে হয় ভালো ঘুম হলে দেখা যাবে শরীর ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। হার্টের কোনো অসুখ বলে আমার মনে হচ্ছে না, যদিও সিম্পটমস্ সব এক। আমার মনে হচ্ছে, অসুখটা মানসিক। ভালোমতো বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে।
অভিজ্ঞ ডাক্তাররাও মাঝে-মাঝে খুব অনভিজ্ঞের মতো করেন। বড় চাচার ওটা ছিল বড় ধরনের একটা এ্যাটাক। তাঁকে সময়মতো হাসপাতালে না নেয়ার কারণেই হয়ত শরীরের ডান দিকটা অচল হয়ে গেল। প্যারালিসিস। ডাক্তাররা খুব সান্ত্বনা দিলেন। ওটা কিছুই না। কমপ্লিট বেডরেস্ট। তারপর কিছু লাইট এক্সারসাইজ। এর বেশি কিছু লাগবে না। নাথিং।
সপ্তাহখানিকের বেশি রেস্ট নেয়া হল, লাইট এক্সারসাইজ করা হল; লাভ কিছু। হল না। অবশ হয়ে-যাওয়া অঙ্গে কোনো সাড়া ফিরে এল না। শুধু সন্ন্যাসী ভোলাবাবু ঘোষণা করলেন-কর্দমমান দিলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। নয়টা চলমান জলধারায় নির্মিত ঘাটের কাদার সঙ্গে নয় বদ্ধ জলাধারের ঘাটের কাদা মিশিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কলাগাছের ভেতরের শাঁস। অশোক গাছের পাতার রস এবং অৰ্জুন গাছের ছাল সিদ্ধ পানিও মেশাতে হবে। ঐ জিনিস রোগীর সারা গায়ে মাখিয়ে রোগীকে সারাদিন রোদে শুইয়ে রাখতে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এতেই কাজ হবে।
অবশ্যই হবে। দ্রব্যগুণ আছে। ওতেই হবে।
কোনো মন্ত্রফন্ত্র নেই?
আছে। মন্ত্ৰও আছে। আপনারা মুসলমান মানুষ। আপনারা তো আর মন্ত্র পড়বেন না। আপনাদের জন্য শুধু দ্রব্যগুণ।
ঠিক আছে। আপনি আপনার কর্দমানের ব্যবস্থা করুন। হলে তো ভালো। টাকাপয়সা কেমন খরচ হবে?
টাকা-পয়সা খরচের জায়গা কোথায়? আমাকে গাঁজা কেনার কিছু দিলেই হবে। আর কিছু লাগবে না-ও, আর মাটির একটি গামলা।