আমি বসার ঘরে ভদ্রলোককে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। ব্যাটা থাকুক খানিকক্ষণ একা বসে। এক সময় বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে চলে যাবে।
জাজ সাহেবকে বসিয়ে রেখে আমি বেশ সময় নিয়ে চা খেলাম। মীরার সঙ্গে ঝগড়া করলাম। মীরার এখন ঝগড়া-রোগ হয়েছে। সবার সঙ্গেই ঝগড়া করছে। প্রেমে পড়লে মেয়েরা কি ঝগড়াটে স্বভাবের হয়? মীরার এবারের প্রেম বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে। ঐ ছোকরা বাড়ির সামনের রাস্তাতেই আস্তানা গেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সিগারেট হাতে সব সময় আছে। আমি খানিকটা খোঁজ-খবর নিয়েছি। জানলাম, সে রেডিও মেকানিক। এই নিয়ে কথা বলতে গিয়েই আপত্তি। আমি শুধু বলেছিলাম তোর ঐ খাতিরের মানুষটা রেডিও মেকানিক।
মীরা চোখ সরু করে বলল, তাতে অসুবিধা কি?
বখাটে ছেলেরা যারা কাজ-টাজ জোটাতে পারে না তারা শেষ বয়সে রেডিও মেকানিক হয়। একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে বসে থাকে।
স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে থাকলে তোর কি অসুবিধা?
আমার কোনোই অসুবিধা নেই। তোর অসুবিধা। যখন তখন তোর মাথায় স্ক্রু টাইট দিয়ে দেবে।
দিক।
আমার তো মনে হয় এখনি অনেকখানি টাইট দিয়ে দিয়েছে। আরো বেশি টাইট দিলে পাঁচ কেটে যাবার সম্ভাবনা।
আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। দয়া করে নিজেকে নিয়ে ভাব।
আচ্ছা। পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালাবি। তোর মেকানিক ব্যাটার হাতে একটা পয়সা নেই বলে আমার ধারণা। ঐদিন দেখলাম বাকিতে সিগারেট কেনার চেষ্টা করছে, দোকানদার দিচ্ছে না।
প্লিজ, তুই দয়া করে আমার সামনে থেকে যা।
আমি বসার ঘরে চলে এসে অবাক হওয়া গলায় জাজ সাহেবকে বললাম–আরে আপনি কখন এসেছেন?
ভদ্রলোক রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তোমার সামনেই তো ঢুকলাম।
সরি, লক্ষ করি নি।
লক্ষ করি নি মানে?
বাসায় অনেক রকম ঝামেলা–মাথা ইয়ে হয়ে আছে……
জাজ সাহেবের রাগ সঙ্গে সঙ্গে কমে গেল। রাগের জায়গায় চলে এল কৌতূহল। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ঐ নার্স মেয়ে কোনো সমস্যা করছে না-কি? কেইস করে দেয় নি তো?
জ্বি না। অন্য সমস্যা।
জাজ সাহেবের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া সরে গেল। তিনি হৃষ্ট গলায় বললেন আর কেইস যদি করেও মজা বুঝিয়ে দেব। বারো হাত কাঁকুড়ের পনের হাত বিচি দেখিয়ে দেব।
কেইস-ফেইস করবে না। ভদ্রমহিলার কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। কেইস করবে কি? খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।
চিন্তার কী আছে? ট্রেস না পাওয়া গেলে তো ভালো কথা।
উনার মেয়েটা এখানে আছে—এই এক সমস্যা।
মেয়েটাকে এখনো নিয়ে যায় নি? বল কি! নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। তুমি এক কাজ করমেয়েটাকে ওর কোনো আত্মীয়-বাড়িতে ফেলে দিয়ে আস। দেরি করবে না। করলে পরে পস্তাতে হবে।
দেখি।
না–দেখাদেখি না। যা করার এক্ষুনি কর। আমি এখন উঠি, দেখি বিকেলে খোঁজ নেব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে টুকু।
চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে লাভ হয় না। ভরসা রাখতে হয় বুদ্ধি ও বিবেচনার উপর।
তাও ঠিক। আপনি তাহলে চলে যান, আমি দেখি কী করা যায়।
জাজ সাহেব চলে গেলেন। হঠাৎ লক্ষ করলাম, রাগে আমার শরীর কাঁপছে।
আজ সকাল থেকেই কেন জানি রাগ লাগছে। কোনোই কারণ নেই, তবু রাগ লাগছে। বাসার পরিস্থিতি ভালো। আনন্দময়। গত পরশু ছোট চাচা সবাইকে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখিয়ে আনলেন। নাটক দেখে ফেরার পথে ঘোষণা করেছেন, আরেকটি গাড়ি কিলবেন। একটা গাড়িতে অসুবিধা হচ্ছে, দুটা হলে ভালো। একটা থাকবে ফ্যামিলির প্রয়োজনে, অন্যটি নিজের।
বড় চাচার মনও খুব উক্ষুণ্ণ। তিনি আরেকজন সাধুর খোঁজ পেয়েছেন। যিনি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশ ঘন্টাই গাছে উঠে বসে থাকেন। গেছো ব্যাঙ-এর মতো গেছে সাধু। এই সাধুনা-কি গত পাঁচ বছর ধরে মৌনব্রত পালন করছেন। দিন সাতেক হলো মৌনব্রতের কাল শেষ হয়েছে। এখন এর-তার সঙ্গে দু একটা কথা বলছেন। সেসব কথার বেশিরভাগই বোঝা যায় না।
আমি সহজ ভঙ্গিতে বলেছিলাম, গাছে থাকতে থাকতে বাঁদর হয়ে যায় নি তো? বাঁদরের ভাষায় কথা বলছে বলেই হয়ত সাধারণ পাবলিক বুঝতে পারছে না।
আমার কথায় সবাই হাসল; এমন কি বড় চাচাও হাসলেন। শুধু বড় চাচী হাসলেন না। তাঁর মনটা এখন খুব অস্থির। অস্থিরতার কারণ হচ্ছে তিনি আমেরিকা চলে যাবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমরা কেউ কোনো উৎসাহ দেখাচ্ছি না, কারণ বড় চাচার শরীর ভালো না। এদিকে চাচীর কোনো লক্ষ নেই। তাঁর কথাবার্তায় বার-বার আমেরিকা প্রসঙ্গ চলে আসছে। মেয়েদের কথা টেনে নিয়ে এসে বলছেন, না জানি ওরা কী কষ্ট করছে। এক হাতে সব করতে হয়। বাচ্চা দুটি হয়েছে মহাদুষ্ট। ছোটটা একবার ওভেনের দরজা খুলে চুপচাপ ভেতরে বসে ছিল। কেউ সুইচ টিপে দিলে কী অবস্থা হত ভেবে দেখ। ওদেরকে একা সামলানো কি সহজ কথা। ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে যায়।
আমরা বুঝতে পারি এসব হচ্ছে বড় চাচীর প্রস্তাবনা। তিনি চাচ্ছেন, আমরা বলি–আপনি চলে যান।
আমরা ভুলেও তা বলছি না। বড় চাচার শরীর খানিকটা খারাপ হলে হয়ত বলতাম, কিন্তু তাঁর শরীর অনেকখানিই খারাপ। গাছে চড়া সাধুর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে সারাক্ষণ ঝিম ধরে আছেন। সারাক্ষণ বসে থাকেন। শুতে পারেন না। বিছানায় গেলেই নাকি পেটে গ্যাস হয়। এই অবস্থায় তাঁকে ফেলে চলে যাবার কথা তিনি ভাবেন কী করে কে জানে।