খালা উঠে এসেছেন। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আতংকিত স্বরে ডাকছে, রিমি, এই রিমি।
রিমি বলল, কী চাও মা?
দরজা বন্ধ কেন?
আমরা গল্প করছি, এই জন্যে দরজা বন্ধ। গোপন গল্প তো। আমরা চাই না সবাই শুনুক।
খালা ভাঙা গলায় বললেন, দরজা খোল মা।
বিরক্ত করো না মা। এখন যাও।
ঐ ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন, কী হয়েছে?
খালা বললেন, কিছু হয় নি। রিমি না খেয়ে শুয়ে পড়েছে, তাই ডাকছি। আপনি রসার ঘরে গিয়ে বসুন।
ঐ ছেলেটা গেল কোথায়? আমি নাহয় ঐ ছেলেটার সঙ্গে গল্প করতাম।
খালা বললেন, ও চলে গেছে। পেছনের দরজা দিয়ে চলে গেছে। বিচিত্র স্বভাব এই ছেলের। কাউকে কিছু না বলে চলে যায়।
খালার কথা শেষ হবার আগেই রিমি উঁচু গলায় বলল, টুকু তো কোথাও যায় নি। এখানেই আছে। আমরা গল্প করছি।
হুড়মুড় শব্দ শুনলাম।
খুব সম্ভব খালা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছেন।
আমি দরজা খোলার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, রিমি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, চুপ করে থাক, নড়বি না।
আমি অন্ধকারে অদ্ভুত মেয়েটার সঙ্গে বসে রইলাম।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটার মতো বাজল। বিরাট নাটক করে বের হলাম। খালার কান্না, দরজার ধাক্কাধাক্কি–কুৎসিত ব্যাপার। ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র খালা বললেন, আর কোনো দিন যদি তোক এ বাড়ির ত্রিসীমানাতে দেখি তাহলে জুতা দিয়ে পিটিয়ে লাশ বানাব। হারামজাদা কোথাকার!
রিমি বলল, মা, একে আমার সামনে ধমকা ধমকি করবে না। আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।
কী বললি?
মুসলমানদের বিয়ে তো খুব সিম্পল—আমি তিনবার বলেছি, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? সে বলেছে কবুল। Now we are husband and wife.
খালা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমি পালিয়ে এলাম।
রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলাম। এই দুঃস্বপুটা আগেও কয়েকবার দেখেছি। আজ আবার দেখলাম, স্বপ্নে একটা পাগল আমাকে তাড়া করছে। পাগলের হাতে চকচকে একটা ক্ষুর। সে মৃদুস্বরে বলছে—ভয়ের কিছুনাই। ব্যথা দিমুনা। ক্ষুর খুব ধার। সে পেছনে পেছনে ছুটছে, তার মুখ দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু স্বপ্নে সবই সম্ভব। আমি পাগলটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। খুব চেনা মুখ অথচ চিনতে পারছি না। পাগলটার মুখে শিশুসুলভ সারল্য, চোখ দুটি মায়া মায়া, গলার স্বরও অতি মধুর। সে খানিকক্ষণ পর পরই বলছে, ভয়ের কিছু নাই। ক্ষুর খুব ধার। পোঁচ কইরা বসামু, টেরও পাবেন না।
জেগে উঠে দেখি, ঘামে সারা শরীর ভেজা। হৃৎপিণ্ড ধক্ ধ করছে। যেন সত্যি সত্যি এতক্ষণ ছুটছিলাম। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার ঘরে পানি থাকে না। একতলায় যেতে হবে পানির খোঁজে, অথচ যেতে ইচ্ছে করছে না, ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, দরজা খুললেই পাগলটার দেখা পাব। স্বপ্নের ঘোর কাটার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ঘোর পুরোপুরি কাটল না।
এ রকম একটা স্বপ্ন বার বার দেখার মানে কি ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই দেখিছোট চাচা। আমার চিলেকোঠার ঘর। দরজা খুললেই পুরো ছাদটা চোখে পড়ে। ছোট চাচা সিগারেট হাতে ছাদে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, দুঃস্বপ্ন। দেখেছিস নাকি?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম—হ্যাঁ, বুঝলেন কী করে?
গোঁ গোঁ শব্দ করছিলি।
খুব খারাপ স্বপ্ন। একটা পাগল ক্ষুর হাতে আমাকে তাড়া করছিল। পাগলটাকে চিনি; আবার চিনি না।
ছোট চাচা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, রাতে কী খেয়েছিলি? গুরুপাক কিছু খেয়েছিস, বদহজম হয়েছে। আমাদের অধিকাংশ দুঃস্বপ্নের কারণ হচ্ছে বদহজম।
তাই নাকি? আমিতো শুনেছি সাব-কনসাস মাইন্ড…
দূর! দূর! স্বপ্নের মূল কারণ হচ্ছে স্টমাক। পেটরোগা মানুষ সব সময় দুঃস্বপ্ন দেখে।
বাজে কটা ছোট চাচা?
ঘড়ি নেই। দুটা থেকে আড়াইটা হবে। আমি একটার সময় ছাদে এসেছি।
ইনসমনিয়া?
হুঁ। আচ্ছা টুকু, ঐ মেয়েটার ব্যাপারে কিছু ভাবছিস? লরেটার কথা বলছি।
না।
ভাবা দরকার তো। আমার মনে হয় সমিতার কোনো আত্মীয়-বাড়িতে রেখে আসা দরকার।
আচ্ছা।
আচ্ছা নয়। কাজটা জরুরি।
জরুরি হলে তো করতেই হবে।
বাচ্চাটা তোর ছোট চাচীর মনে চাপ ফেলেছে। ও এখানে বেবি এক্সপেক্ট করছে। এই সময় মনে চাপ পড়লে বেবির গ্রোথ ভালো হয় না। বুঝতে পারছিস কী বলছি?
পারছি।
হুট করে একটা বাজে ঝামেলায় জড়িয়ে…
এখন তো ঝামেলা শেষ। আনন্দের শুরু।
ঠাট্টা করছিস না-কি?
না। ঠাট্টা করছি না। ঠাট্টা করব কেন? ছাদে বেশিক্ষণ একা থাকা ঠিক না। ভূতের উপদ্ৰব।
ভূতের উপদ্রব মানে।
কমলা প্রায়ই ভূত দেখে।
তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছি নাকি? রাস্কেল।
আমি সহজ মুখে নিচে নেমে এলাম।
এক তোড়া গোলাপ
আজ জাজ সাহেব দুটো গোলাপের জায়গায় এক তোড়া গোলাপ পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। শুটকো লোকটা সাইকেলে করে গোলাপ নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে তিনিও একই সঙ্গে রিকশা করে উপস্থিত হয়েছেন। গোলাপগুলো তিনি নিজেও আনতে পারতেন, তা আনেন নি।
বসার ঘরে ঢোকার মুখে আমার সঙ্গে দেখা। তিনি উজ্জ্বল চোখে বললেন, এগারোটা গোলাপ এনেছে এগার ভ্যারাইটির।
আমি শুকনো গলায় বললাম, ও।
তুমি বোধহয় গোলাপ পছন্দ কর না?
জ্বি না। কোন কাজে আসে না, তাই পছন্দ করি না।
কাজে আসে না বলতে কী মিন করছ?
কুমড়ো ফুলের কথাই ধরুন। দেখতে সুন্দর। একে বড়া বানিয়েও খাওয়া যায়। গোলাপের নিশ্চয়ই বড়া হয় না। না-কি হয়?
তুমি কি ঠাট্টা করছ?
জ্বি না। ঠাট্টা করব কেন? আপনি বসুন, আমি ভেতরে খবর দিচ্ছি।