তা বলেছিলেন।
ছোট্ট একটা সমস্যা অবশ্যি থেকেই গেল।
কোন সমস্যার কথা বলছেন?
বাচ্চা মেয়েটার কথা বলছি। লরেটা বোধহয় নাম।
ওর কী সমস্যা?
আমার তো মনে হয় ওর মা তাকে নিতে আসবে না।
আপনি কি ভবিষ্যদ্বাণী করছেন?
জ্বি না। অনুমানে বলছি। পাঁচ দিন হয়ে গেল, এখনো আসছে না ভয়ংকর কিছু নাহলে তো এক জন মা কখনো এই কাজ করবে না। আচ্ছা, এখন যান ঘুমান গিয়ে।
আমি বুঝলাম, সন্ন্যাসী পাশ ফিরল এবং সঙ্গে সঙ্গে নাক ডাকা শুরু হল। সত্যি সত্যি কি সে ঘুমিয়ে পড়েছে, না-কি আমাকে অভিভূত করবার জন্যে ভান করছে? সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রচুর ভান করতে হয়। তাদের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্যের একটি হচ্ছে ইমেজ রক্ষা। ব্যাটা সম্ভবত সারাক্ষণই জেগেছিল। নাক ডাকাটা তার কোনো এক কৌশল। কৌশল হলেও মজার কৌশল। গন্ধের ব্যাপারটাও চমৎকার, তবে হকচকিয়ে যাবার মতো কিছু নয়। কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি কিছু মানুষের মধ্যে অবশ্যই থাকতে পারে। পশুদের স্বভাব-চরিত্রের অনেক কিছুই তো মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
আমি দোতলায় উঠে এলাম, তবে সন্ন্যাসীকে মন থেকে পুরোপুরি তাড়াতে পারলাম না। একটা সিগারেট নিয়ে আবার কি ফিরে আসব? খানিকক্ষণ গল্প করব? মন্দ কী?
নিজের ঘরে ঢুকে নামতে ইচ্ছা করল না। ঘুম পেতে লাগল। প্ৰচণ্ড ঘুম পাওয়ার। লক্ষণটা ভালো না। এই জাতীয় ঘুম বিছানায় যাবার আগ পর্যন্ত থাকে। বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। আমার বেলায়ও তাই হল। বালিশে মাথা রাখামাত্র ঘুম চলে গেল। ঘরে শুয়ে অনেক রকম পরিকল্পনা করলাম। তার একটি হল বাচ্চা মেয়েটির মাকে খুঁজে বের করা।
আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রমহিলাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। রাত এগারোটার দিকে যে বাড়ির সামনে নামিয়ে রেখে এসেছিলাম। সে বাড়িতে সমিতা ছিল মাত্র এক রাত। ভোরবেলাতেই সুটকেস নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় তাও বাড়ির কেউ জানে না। জানার আগ্রহও নেই। যেখানে ইচ্ছা যাক সবারই এরকম একটা মনোভাব।
আমি সারাদিনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুজতে লাগলাম। এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে অন্য আত্মীয়ের বাড়ি। কেউই কিছু জানে না। গ্রামের বাড়িতে খোঁজ করব সেই উপায়ও নেই, কারণ ভদ্রমহিলার গ্রামের বাড়ি নেই। কোলকাতার মেয়ে। উনিশ শ ষাট সনে ঢাকায় এসেছে।
রাত এগারোটায় খোঁজার পর্ব বন্ধ করলাম। জায়গাটা খারাপ। যে কোনো মুহুর্তে ঘড়ি, মানিব্যাগ, শার্ট, স্যুয়েটার খুলে নেবে। কপাল মন্দ হলে পেটে ক্ষুর ঢুকিয়ে দু একটা পপাঁচ দেবে। আগে এসব ক্ষেত্রে চিৎকার-চেঁচামেচি করলে লোকজন ছুটে আসত, এখন দৌড়ে উল্টো দিকে পালিয়ে যায়। বিটের পুলিশ হঠাৎ করে বধির হয়ে যায়, তাদের চলৎশক্তি থাকে না। তারা উদাস দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটা দেখে।
আমি ঠিক করলাম, রিমিদের বাসায় চলে যাব। রিমিদের বাসা কাছেই। সে গাড়ি করে নিশ্চয়ই আমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। রিমিদের বসার ঘরে আলো জ্বলছে। ঢুকে দেখি, খালা সেজেগুজে বসে আছেন। তাঁর সামনে কালো জ্যাকেট পরা এক ভদ্রলোক। দুজনের সামনেই কফির কাপ। খালা কুঁচকে বললেন, তুই কী মনে করে?
যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে, ভাবলাম…
কোনো খবর আছে, না এম্নি এসেছিস?
খবর নেই, এম্নি।
খালা বিরক্ত গলায় বললেন, দুপুররাতে মানুষের বাসায় আসার মানে কি? তোদর কি কাণ্ডজ্ঞান কখনো হবে না?
আমি অপমান হজম করে হাসিমুখে বললাম, রিমি বাসায় আছে?
বাসায় থাকবে না তো যাবে কোথায়? ও ঘুমুচ্ছে। তুই বোস এখানে, নাকি চলে যাবি?
বসি খানিকক্ষণ।
আমি বসামাত্রই ভদ্রলোক গল্প শুরু করলেন। ভদ্রলোক মনে হল। হিমালয়বিশারদ। হিমালয় ভ্রমণের কাহিনী খুব বিতং করে বলছেন।
হরিদ্বার হচ্ছে হিমালয়ের সিংহ-দরজা। কোলকাতা থেকে হরিদ্বার যাবার দুটো ট্রেন আছে। একটা হচ্ছে দুন এক্সপ্রেস। রাত নটা দশ মিনিটে ছাড়ে। অন্যটা হচ্ছে। জনতা এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে হরিদ্বারের দূরত্ব হচ্ছে পনের শ কিলোমিটার।
খালা বললেন, পনের শ কিলোমিটার সমান কত মাইল?
ওয়ান পয়েন্ট সিক্স কিলোমিটার হচ্ছে এক মাইল, কাজেই এবাউট…
ভদ্রলোককে হিসেব শেষ করতে না দিয়েই খালা কিশোরীদের গলায় বললেন, আপনি এত কিছু জানেন।
ভদ্রলোক এর উত্তরে হাসিমুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগে দরজার পর্দা সরিয়ে রিমি ঢুকে বরফের মতো গলায় বলল, টুকু, তুই ভেতরে আয়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলাম। রিমি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, ঐ লোক কখন থেকে বক্ বক্ করছে জানিস?
সন্ধ্যা থেকে?
না। দুপুর থেকে। দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করেছে। তারপর থেকে বকবকানি চলছে।
যেতে চাচ্ছে না?
চাচ্ছে হয়ত, মা যেতে দিচ্ছে না। আমার অসহ্য লাগছে। তুই এসেছিস ভালো হয়েছে। এখন আমি মাকে একটা ভয় দেখাব। তোকে ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দেব।
তাতে লাভ কী?
তোর কোন লাভ নেই, মা ভয়ে ছটফট করবে, এটাই লাভ।
বলতে বলতে রিমি দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিল।
আমার গা ছম ছম করতে লাগল। রিমি বলল, খবৰ্দার, গায়ে হাত দেবার চেষ্টা। করবি না। গায়ে হাত দিলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।
আমি ফিস ফিস করে বললাম, তুই এত পাগল হলি কিভাবে?
রিমি বিরক্ত স্বরে বলল, পাগলের তুই কি দেখলি? আমি যা করছি খুব ভেবেচিন্তে করছি। মাকে আজ আমি একটা শিক্ষা দেব।