কি, বলতে পারলি না? একজেক্ট ফিগার বলতে পারলে দশ টাকা দেব।
মীরা সম্ভবত আবার কোনো ছেলের প্রেমে পড়েছে। একটি বিরহের গান দিনে পঞ্চাশ বার বাজাচ্ছে। গানের ভাব হচ্ছে—তুমি আর আমি দুই পথের যাত্রী। এই জীবনে দুই পথ এক হবে না ইত্যাদি। শুটকো মতো একটা ছেলেকে ঘাড় কুঁজো করে প্রায়ই আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ছোকরাই মীরার সাম্প্রতিক প্রেমিক। রূপবতী মেয়েরা প্রেমিক হিসেবে কুৎসিত ছেলেদের বেশি পছন্দ করে কেন কে জানে।
ছোট চাচা ফিরে এসেছেন। রোগী দেখা শুরু করেছেন। রোগী আসছে স্রোতের মতো।
ছোট চাচীও ফিরে এসেছেন। তাঁর ঘন ঘন অসুখ হবার ঝামেলাটা এই শীতে একটু কম বলে মনে হচ্ছে। গতকাল আমার সঙ্গে হাসিমুখে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। আলাপের বিষয়বস্তু হচ্ছে—তিনি শিগগিরই বাচ্চা নেবার কথা ভাবছেন। যদিও বাচ্চা নেয়া মানে ফিগারের দফারফা, তবু নেবেন। ব্রেস্ট ফিডিং না করালেই হল। আলাপের এক পর্যায়ে বললেন, মেয়েদের বুকের সেইপ নষ্ট হয়ে গেলে তো সবই নষ্ট। তাই না টুকু?
আমি উত্তর না দিয়ে ঢোঁক গিললাম। তিনি হাসিমুখে বললেন, তুমি দেখি লজ্জায় একেবারে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ। লজ্জা পাবার মতো কী বললাম? যা বলেছি সবই সত্যি। হার্ড ফেক্ট। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
পত্র পুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্ৰাতা পূজার কুসুম দুটি।
রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানবেরই যদি এই ভাব হয় তাহলে সাধারণ পুরুষদের অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখ….
আলোচনা বেশিদূর এগুতে না দিয়ে আমি চলে এলাম। এ বাড়ির সবাই সুখে আছে। এটাই আমার সুখ। তবে কুসুমে কাঁটার মতো একটা কাঁটা এখনো আছে। সমিতা তার মেয়েটিকে নিয়ে যায় নি। বাড়ির কেউ তা নিয়ে চিন্তিতও না। মেয়েটি কান্নাকাটি করছে না, হৈচৈ করছে না, এতেই সবাই খুশি। আমি তাকে রোজ স্কুলে দিয়ে আসছি, স্কুল থেকে নিয়ে আসছি। সে একবারও তার মার কথা জিজ্ঞেস করছে না। আমিও নিজ থেকে কিছু বলছি না। রাতে ঘুমুবার আগে দুজন বয়স্ক মানুষের মতো খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করি। আমার জন্মদিনে রিমি যে কাণ্ডটা করল আমি তা বেশ সহজভাবেই তাকে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, রিমির এই কাজটা কি উচিত হয়েছে?
লরেটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলল, উনি তোমাকে খুব পছন্দ করে তো, তাই তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। পছন্দের মানুষকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে।
কে বলল তোমাকে?
মা বলেছে। এই যে মা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে না; তার কারণ মা আমাকে পছন্দ করে।
তুমি ঘুমাও।
আচ্ছা।
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার মনটা এতই খারাপ হল যে, ঘুম এল না। ছাদে অনেকক্ষণ পায়চারি করলাম। বড় বড় নিঃশ্বাস নিলাম। প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন শরীরে নিলে না-কি ঘুম পায়। ঘুম পেল না। তৃষ্ণা পেয়ে গেল।
আজ ঘরে পানির জগ রাখতে ভুলে গেছি। নামতে হল একতলায়। পর পর তিন গ্লাস পানি খাবার পরও তৃষ্ণা মিল না। তৃষ্ণা ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। মাঝে মাঝে কিছুতেই তৃষ্ণা মেটে না। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে সত্যি, না সার ক্ষেত্রে তা জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
বসার ঘর থেকে নাক ডাকার অদ্ভুত শব্দ আসছে। সন্ন্যাসী ভোলাবাবু নাক ডাকাচ্ছে। কিছুদিন ধরে এই সন্ন্যাসী রোজ আসছে। বড় চাচার সঙ্গে গুজ গুজ, ফিস ফিস করছে। রাতে বসার ঘরের কার্পেটে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। দারোয়ান বা মালীর ঘরে সে ঘুমুবে না, ঘুমুবে বসার ঘরে। আমার মার ধারণা, এই ব্যাটা একরাতে আমাদের খুন-টুন করে জিনিসপত্র নিয়ে পালাবে। মা তার এই আশংকার কথা অনেককেই বলেছেন, কেউ আমল দেয় নি।
সবার ঘরে উঁকি দেবার আমার কোনোই প্ৰয়োজন ছিল না—সম্ভবত নাক ডাকার শব্দে আকৃষ্ট হয়েই উঁকি দিলাম। ঘর অন্ধকার, সন্ন্যাসী নাক ডাকাচ্ছে অথচ আমি পা দেয়ামাত্র সে ভারী গলায় বলল, ভাইজানের কাছে সিগারেট আছে? আমি হকচকিয়ে গেলাম।
আছে ভাইজান সিগ্রেট?
আপনি কি জেগে ছিলেন না-কি?
জ্বি না, ঘুমাচ্ছিলাম।
আমি ঘরে পা দেয়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল?
জ্বি।
এবং অন্ধকারেও বুঝতে পারলেন আমি কে?
জ্বি।
কিভাবে বুঝলেন? আপনি কি অন্ধকারে দেখতে পান?
জ্বি না। অন্ধকারের দেখব কিভাবে? আমি তো আর বিড়াল না।
তাহলে বুঝলেন কী করে যে এটা আমি।
গন্ধ থেকে বুঝলাম।
গন্ধ থেকে বুঝে গেলেন?
জ্বি। সব মানুষের শরীরের গন্ধ আছে। মানুষের সঙ্গে যেমন মানুষের মিল নাই, এক মানুষের গন্ধের সঙ্গেও আরেক মানুষের গন্ধের কোনো মিল নাই।
আপনি কি সবার গন্ধ আলাদা করে চেনেন?
জ্বি না। যাদের সাথে কয়েকবার দেখা হয়, তাদেরটা চিনি। সিগ্রেট আছে ভাইজান?
সঙ্গে নেই, তবে ঘরে আছে।
থাক, বাদ দেন। তিনতলায় যাবেন আবার নামবেন। দরকার নাই।
দরকার নাহলে তো ভালোই। যাবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি তৃষ্ণা প্রসঙ্গে। আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে খুব পানির তৃষ্ণা হয়েছে, পানি খেয়েই যাচ্ছেন কিন্তু তৃষ্ণা মিটছে না?
না। শরীরের তৃষ্ণা তো সহজেই মেটার কথা। মনের তৃষ্ণা নিয়েই সমস্যা। ঐ তৃষ্ণাটা কখনো মিটে না।
এইসব কথাবার্তা আপনি কি ভেবেচিন্তে বলেন, না যা মনে আসে বলে। ফেলেন?
যা মনে আসে বলি না। টুকু সাহেব?
জ্বি।
আপনাদের সমস্যা তো মিটে গেল।
তাই তো দেখছি।
ট্রাকে করে কুদ্দুসের ডেডবডি নিয়ে যাবার সময় আপনাকে বলেছিলাম না, এই মৃত্যুর পর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?