সমিতা আমার ঘরে ঢুকে খুব সহজ গলায় তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলল। তাদের পুরো কথোপকথনটি হল আমার সামনে। যেন সমবয়েসী দুজন মানুষ কথা বলছে।
মা-মণি, আমি আজ রাতে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
আমিও কি যাচ্ছি?
না, তুমি আরো দু একদিন থাকবে। পারবে না?
পারব।
আগের বাসাটা তো ছেড়ে দিয়েছি। কোথায় গিয়ে উঠব তা তো জানি না। কাজেই এখন তোমাকে নিচ্ছি না। বুঝতে পারছ?
পারছি। মা, ওরা কি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে?
হ্যাঁ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, ওরা তাড়িয়ে দেবে।
তাহলে মামণি আমি এখন যাই?
আচ্ছা যাও।
সমিতা ঘর থেকে বের হবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি কি কিছু বলবে? লরেটা শান্ত গলায় বলল, এই কদিন কি আমি স্কুলে যাব?
দরকার নেই। একা একা এত দূর যেতে পারবে না।
টুকুকে বললে ও আমাকে নিয়ে যাবে।
সমিতা বিস্মিত হয়ে বলল, নাম ধরে ডাকছ কেন?
ও তো আমার বন্ধু; কাজেই নাম ধরে ডাকছি। ও আমাকে নাম ধরে ডাকতে বলেছে।
সমিতা পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। পূর্ণ দৃষ্টিতে কেউ যখন তাকায় তখন তার চোখের ভেতর দিয়ে তাকে অনেকখানি দেখা যায়। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সমিতা নামের এই মেয়েটি তো বড় ভালো। আমি বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে দেখেশুনে রাখব।
সমিতা কিছু বলল না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
রাত নটায় একটি বেবিট্যাক্সি ডেকে আনা হল। সমিতা একটা বড় সুটকেস, একটা হ্যান্ডব্যাগ এবং একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে পেছনের সিটে উঠে বসল। বিদায়ের সময় পুরুষদের কাউকে দেখা গেল না, তবে মেয়েরা সবাই এল। মা বললেন, টুকু, তুই এর সঙ্গে যা। রাত হয়েছে, পৌঁছে দিয়ে আয়।
সমিতা না-সূচক কিছু বলতে যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত বলল না। সম্ভবত তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমি ড্রাইভারের পাশে জায়গা করে বসে পড়লাম। গাড়ি উত্তর শাহজাহানপুর ছাড়িয়ে প্রায় বস্তির মতো কিছু ঘরবাড়ির সামনে থামল। জায়গাটা ঢাকা শহরের ভেতরে হলেও ইলেকট্রিসিটি নেই। কাছেই কোথাও মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনা ফেলে নিচু জায়গাটা ভরাট করা হচ্ছে। সেই আবর্জনার ভয়াবহ উৎকট গন্ধ। নাডিডি উলটে আসার জোগাড়।
আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। অনেকটা রাস্তা হেটে যেতে হবে। আমি বললাম, সুটকেসটা আমাকে দিন। মেয়েটা বিনা বাক্যব্যয়ে সুটকেস দিল। বেবিট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা রওনা হলাম। সারা পথ কথাবার্তা হল না। একটা একতলা দালানের সামনে এসে সমিতা বলল, এই বাড়ি।
আমি সুটকেস নামিয়ে নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, আমি দুঃখিত এবং লজ্জিত।
সমিতা অসম্ভব নরম গলায় বলল, কেন?
আমি সেই কেন-র জবাব দিতে পারলাম না। সুটকেস নামিয়ে রেখে এলাম। বেবিট্যাক্সির কাছে এসে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, সমিতা তখনো ঘরে ঢেকে নি। তার জিনিসপত্র নিয়ে অন্ধকারে একতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক করে রেখেছিলাম, সকাল সাড়ে দশটায় নিউমার্কেটে যাব না। রিমি রাগ হলে হোক, বিরক্ত হলে হোক।
যে রকম ভেবে রেখেছিলাম, সে রকম করা গেল না। আমি সাড়ে দশটা বাজার পনেরো মিনিট আগেই এসে উপস্থিত হলাম। বারোটা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করলাম বইয়ের দোকানগুলোর সামনে। রিমির দেখা নেই। সাড়ে বারোটায় এক ডিসপেনসারি থেকে টেলিফোন করলাম। রিমি বাসাতেই আছে। আমি আহত স্বরে বললাম, রিমি, তোর না আসার কথা। রিমি বলল, আমি আসব, এমন কথা তো বলি নি। তোক আসতে বলেছি।
কেন?
এম্নি।
এম্নি কেন?
এম্নি মানে এম্নি। আচ্ছা শোন, তুই প্রেসক্রিপশনটা পেয়েছিল?
হ্যাঁ, কিসের প্রেসক্রিপশন?
ঘোড়া এবং গরুর অসুখ-বিসুখ হলে এই প্রেসক্রিপশন পশুডাক্তাররা দেন। তোকে দিচ্ছি, কারণ, তোর কাজে লাগবে।
ও আচ্ছা।
রাগ করলি নাকি?
না।
তোর কথা শুনে কিন্তু মনে হচ্ছে রাগে কাঁপছিস।
কিছুটা রাগ যে করি নি, তা না। তবে রাগে কাঁপছি না।
আচ্ছা, আমি কি তোর সঙ্গে একটু ঠাট্টাও করতে পারব না?
ঠাট্টা।
হ্যাঁ ঠাট্টা। আজ দিনটা ঠাট্টার জন্যে চমৎকার। তুই ভুলে বসে আছি, আজ তোর জন্মদিন। গত জন্মদিনে তোক বলেছিলাম না আগামী জন্মদিনে তোকে ঘোল খাওয়াব? মনে পড়েছে?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
এখনো রাগ আছে?
না।
তোর জন্যে একটা উপহার কিনে গতকাল নওরোজ কিতাবিস্তানে দিয়ে এসেছি। ওখানে গিয়ে আমার নাম বললেই দেবে।
এটাও নিশ্চয়ই ঠাট্টা?
না, ঠাট্টা না। পরপর দুবার ঠাট্টা করা যায় না। লেবু একবারই কচলানো যায়। দুবার কচলালে তেতো হয়ে যায়। উপহার তোর পছন্দ হয়েছে কিনা জানাবি। সুন্দর করে গুছিয়ে চিঠি লিখে জানাবি।
আর যদি অপছন্দ হয়?
অপছন্দ হলে চিঠি-ফিটি লিখতে হবে না। তবে অপছন্দ হবে না। যদিও তার রুচি খুব খারাপ।
থ্যাংকস।
থ্যাংকস কেন? উপহারের জন্যে? নাকি জন্মদিন মনে রাখার জন্যে?
জন্মদিন মনে রাখার জন্যে।
তোর নিজের মনে ছিল না। তাই না?
হ্যাঁ, তাই।
তুই যা। নওরোজ কিতাবিস্তানে চলে যা। গিয়ে আমার নাম বলবি।
আচ্ছা যাচ্ছি। থ্যাংকস এগেইন।
বার বার থ্যাংকস দিতে হবে না। এটা বিলেত-আমেরিকা না। ফোন রাখলাম। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
আমি সেই দোকানে গেলাম। দোকানের মালিক অবাক হয়ে বললেন, কই, আমাদের কাছে তো কেউ কিছু দিয়ে যায় নি।
আমরা ভয়াবহ যন্ত্রণায় ছিলাম
আমাদের দেখে কে বলবে চার দিন আগেই আমরা ভয়াবহ যন্ত্রণায় ছিলাম?
কেউ বলবে না।
বলার কথাও নয়।
এখন সব স্বাভাবিক। বড় চাচা ব্যাগ বোঝই করে বাজার করছেন। শীতের নতন আনাজ উঠেছে-অবিশ্বাস্য দামে তিনি সেসব কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন এবং সবাইকে ধাঁধা ধরার মতো করে বলছেন, বল তো, টমেটো কত করে আনলাম?