আমি টেলিফোন কানে নিয়ে বসে রইলাম। খালা রিমিকে ডাকতে গেলেন।
রিমি টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিয়েই শীতল গলায় বলল, কাল সকাল দশটায় নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানগুলোর আশপাশে থাকবি।
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আমি বৃথাই খানিকক্ষণ হ্যালো, হ্যালো করলাম।
মনস্থির করে ফেললাম, আগামীকাল সকাল দশটায় নিউমার্কেটের ধারেকাছেও আমি থাকর না। আমাকে না দেখে সে অবাক হবে, দুঃখিত হবে, বিস্মিত হবে। এই তিন ধরনের অনুভূতি একত্রে খানিকক্ষণ খেলা করবে, তারপর রাগে তার শরীর জ্বলে যাবে। জ্বলুক। ডাক দিলেই ছুটে যেতে হবে? রূপবতীদের একসময়-না-একসময় বুঝিয়ে দিতে হয় তাদের ডাক নিশিডাকের মত না। তাদের ডাকও অগ্রাহ্য করা যায়।
তাছাড়া ওর ডাকে ছুটে যাওয়া মানে সেধে অপমানিত হওয়া। একবার ঠিক দুপুর দুটায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতে বলল। কাঁটায় কাঁটায় দুটার সময় আমি যেন দুপ্যাকেট চিপস এবং এক প্যাকেট কাজুবাদাম নিয়ে উপস্থিত থাকি। বোটানিক্যাল গার্ডেন কি এখানে? মিরপুর ছাড়িয়েও আরো অনেকখানি। দুপুরে না খেয়ে তিনবার বাস বদল করে ঘামতে ঘামতে পৌঁছলাম। সাড়ে তিনটা পর্যন্ত গেটে লাইটপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। রিমির দেখা নেই। খিদেয় অস্থির হয়ে চিপস এবং কাজুবাদাম নিজেই খেয়ে ফেললাম এবং খুব ঠাণ্ডা মাথায় পর পর তিনবার বললাম, রিমি নামে কাউকে আমি চিনি না, রিমি নামে কাউকে আমি চিনি না, রিমি নামে কাউকে আমি চিনি না।
তবে নিউমার্কেট হাতের কাছে। ইচ্ছা করলে একবার উঁকি দিয়ে দেখা যায়। এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আমি জানি ইচ্ছা করবে। দশটা বাজার কয়েক মিনিট আগে মনে হবে বিশ্ব-সংসার রসাতলে যাক, আমি নিউমার্কেটে যাব।
আগামীকাল বাসায় থাকা আমার খুবই জরুরি। কারণ মির্যাকল ঘটে গেছে। ছোট চাচী সত্যি সত্যি চলে আসছেন। দুই পক্ষের কথাবার্তায় ঠিক হয়েছে অতীত ভুলে নতুন করে সব শুরু করা হবে। পুরনো কথা ভোলা হবে না। যা হবার হয়ে গেছে। নার্স মেয়েটিকে টাকা-পয়সা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ব্যবস্থা করা হবে। সবার ধারণা, এই মেয়ে বেঁকে বসবে। এরকম কিছু হলে শক্ত হতে হবে। দরকার হলে ভয় দেখাতে হবে। ছোট চাচা তাঁর ফাইনাল কথা বলে দিয়েছেন। তিনি আমার মাকে ছাদে ডেকে নিয়ে বলেছেন—আপনারা যা ভালো বোঝেন করেন, আমার কিছু বলার নেই। মা এই কথা শুনে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নেমে এসেছেন।
আজ রাতে সমিতাকে বড় চাচার ঘরে ডাকা হবে। সেখানে শুধ মরুরীরা থাকবেন। তাঁরা তাকে বোঝবেন, দরকার হলে ভয় দেখাবেন। এই আসরে ছোট চাচীর বাবা জাজ সাহেবও থাকতে চেয়েছিলেন, তাঁকে নিষেধ করা হয়েছে। বড় চাচা বলেছেন, আমাদের সমস্যা আমরাই মেটাব। আপনি মুরুত্বী মানুষ আপনার থাকার দরকার নেই। জাজ সাহেব বলেছেন, লিগ্যাল পয়েন্টগুলো মেয়েটিকে ভালোমলতা বুঝিয়ে দেবেন। তাকে পরিষ্কার বলবেন যে, তার বিয়ে অসিদ্ধ। কোর্ট এ্যাকসেপ্ট করবে না। আমরা কোর্টে প্রমাণ করে দেব যে, ছেলেকে ট্রাপে ফেলে এই বিয়ে করা হয়েছে। বিয়ের মূল লক্ষ ছিল অর্থ আত্মসাৎ। এটা প্রমাণ করা গেলে তারই বিপদ, উল্টো জেল খাটতে হবে। আপনারা বলবেন যে, আমরা কোর্ট-ফোর্টের ঝামেলায় যাব না, শান্তিপূর্ণ সমাধানই আমাদের লক্ষ।
বড় চাচা বললেন, সব পয়েন্ট বলা হবে।
শুধু পয়েন্ট বললে হবে না থ্রেট করতে হবে। এই জাতীয় মেয়েরা তেড়িয়া কিসিমের হয়। এদের ঘাড়ের রগ থাকে একটা মোটা।
কারেক্ট বলেছেন। একটা না, এদের ঘাড়ের সব কটা রগ থাকে মোটা।
দেখা গেল সমি নামের মেয়েটির ঘাড়ের রগ মোটা নয়, সে তেড়িয়া কিসিনেরও নয়। বড় চাচার ঘরের মাঝখানের চেয়ারে শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। আমি তার মুখের ভাব দেখতে পারছিলাম না। কারণ, আমি ঘরের বাইরে জানালার পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটির পেছনটা দেখতে পাচ্ছি।
বড় চাচা বললেন, আমি কী বলছি বুঝতে পারছ?
পারছি।
তোমার কি কিছু বলার আছে?
না।
বলার থাকলে বলতে পার। আমরা তোমার কথাও শুনব। আমরা ঝগড়া করতে বসি নি।
আপনারা কি আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছেন?
অবশ্যই।
আপনার ছোট ভাই অর্থাৎ ডাক্তার সাহেব, তিনিও কি তাই চান?
সে না চাইলে আমরা মিটিঙে বসলাম কেন? সে-ই বেশি চাইছে।
বেশ, আমি চলে যাব।
বড় চাচা অত্যন্ত রাসভারী গলায় বললেন, তোমার যদি কিছু বলার থাকে, বলতে পার। আমরা শুনব।
আমার কিছুই বলার নেই।
তুমি যদি মনে কর কোর্টের আশ্রয় নেবে, তাহলে ভুল করবে।
আপনাদের চিন্তার কিছুই নেই। আমি কোর্টে যাব না।
অবশ্যি তমি চাইলে কমপেনসেশনের ব্যাপারটা নিয়েও আমরা চিন্তা করব। এটা আমরা পুরোপুরি রুল আউট করে দিচ্ছি, তা না। যদিও লিগ্যালি ইউ আর নট বাউন্ড।
সমিতা সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, আমি তাহলে যাই।
এখনি যাবে?
হুঁ। মেয়েটা থাকবে। কোথায় গিয়ে উঠবো কোনো ঠিক নেই। আগে একটা থাকার ব্যবস্থা করে তারপর ওকে নিয়ে যাব।
এখনই যে যেতে হবে, তা না। কাল ভোরে মেয়েটাকে নিয়ে একসঙ্গে যাও।
আপনাদের ভয় করার কিছু নেই। মেয়েটাকে আমি আপনাদের ঘাড়ে ফেলে রেখে যাব না। নিয়ে যাব। দু এক দিনের মধ্যেই নেব। আমি যাব আজ রাতেই।
সবার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেল। এত বড় একটা ঝামেলা এত সহজে মিটে যাবে, তা কেউ ভাবে নি।