সংসারে এক জন সিরিয়াস ধরনের রোগী থাকার অনেক সুবিধা। খুব কাজে লাগে। অবশ্যি ছোট চাচীর ব্যথার সমস্যা না থাকলেও যে মা মেজো খালার বাসায় যেতেন তা মনে হয় না। ফরিদা খালা মার আপন বোন না। খালাতো বোন। যাকে মা খুবই অপছন্দ করেন। শুধু মা একা না, এই মহিলাকে কেউ দেখতে পারে না। সুন্দরী এক জন মহিলা, যে খুব চমৎকার করে কথা বলে, তাকে কেন সবাই এত অপছন্দ করে কে জানে। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়ই মনে হয়। ভদ্রমহিলার কথাবার্তা ভালো। বেশ আদুরে ভঙ্গি আছে। বাসায় গেলে প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেন। তবু কেউ তাঁকে দেখতে পারে না।
আসলে অপছন্দ করা উচিত মেজো খালুকে। ভদ্রলোক দেখতে কোলা ব্যাঙের মত। মুখের হাঁ-টা অনেক বড় বলে যখনই সেন তখনই আলজিত দেখা যায়। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের ভুড়ি লাফালাফি করে। কুৎসিত দৃশ্য। স্বভাবটাও কুৎসিত। অসম্ভব কৃপণ। আটচল্লিশ বছর বয়সেই বাড়ি-গাড়ি করে হুলস্থূল করেছেন, অথচ হাত দিয়ে একটা পয়সা বের হয় না। আমার বড় বোন ইরার বিয়েতে এসেছিলেন। খালি হাতে। অবশ্যি এসেই বললেন, জামাইয়ের জন্যে একটা স্যুটের কাপড় কিনে রেখেছি। জামাইকে একবার পাঠিয়ে দেবেন, দরজির কাছে মাপ দিয়ে আসবে। শুধু শুধু স্যুটের কাপড় দেয়ার কোন অর্থ হয় না। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, কাপড়ের চেয়ে দরজির খরচ বেশি।
ইরার স্বামী-বেচারা এখনো সেই স্যুট পরতে পারে নি। নতুন জামাই তো আর ঐ বাড়িতে গিয়ে বলতে পারে না-খালুজান, স্যুটের মাপ দিতে এসেছি।
আমার ধারণা, মেজো খাল স্যটের কাপড়ের কথা বলে প্রচুর বিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছিলেন। বেঁচে থাকলে হয়ত আরো খেতেন।
না। এক জন মৃত মানুষ সম্বন্ধে এইসব ভাবা উচিত না। ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই অনেক ভালো গুণ ছিল, আমরা যার খবর রাখি না। এক জন মৃত মানুষ সম্পর্কে ভালো ভালো কথা ভাবা দরকার। চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে অনেক চেষ্টা করলাম ভদ্রলোক সম্পর্কে ভালো কিছু মনে করতে। মনে পড়ল না।
চা শেষ করে উঠতে যাব, মা বললেন, সময় করে একবার ও বাড়িতে যাস তো। কেউ না গেলে খারাপ দেখায়।
আমি বললাম, আচ্ছা। আমাদের বাড়ির সিনিয়র মানুষদের কোনো কথাতেই আমি না বলি না। এতে সবার ধারণা হয়েছে যে, আমি এক জন অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্রছেলে, তবে কিঞ্চিৎ বোকা। বোকা না হলে কেউ কি আর সব কথাতেই হ্যাঁ বলে? অবশ্যি এম্নিতেও আমি আমার বুদ্ধিমত্তার তেমন কোন প্রমাণ দেখাতে পারি না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বি.এ পাস করে বর্তমানে নাইট সেকশনে ল পড়ছি। কেন পড়ছি নিজেও জানি না। ল পাস করে কোর্টে গিয়ে ফাটাফাটি করব এই জাতীয় দিবাস্বপ্ন আমার নেই। পড়তে হয় বলে পড়া। শুনেছি লতে ভর্তি হয়ে থাকলে দুতিন বছর পর আপনা-আপনি ডিগ্রি হয়ে যায়। সেই ভরসাতেই আছি। বাড়ির অন্যদেরও আমার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। আমার সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব হচ্ছেকরুক যা ইচ্ছা, কোনো ঝামেলা তো করছে না। বেচারা আছে নিজের মতো।
আমাদের বাড়ির লোকজনদের কিছু পরিচয় দেয়া মনে হয় দরকার। এ বাড়ির সবচে সিনিয়র এবং সবচে নির্বোধ ব্যক্তি হচ্ছেন আমার বড় চাচা। বয়স তেষট্টি। দৈত্যের মতো শরীর। যাকে বলে বৃষ-স্কন্ধ। এখনো নিয়ম ধরে একসারসাইজ করেন। ভোরবেলা ছোলা এবং মধু খান। রাতে ঘুমুবার আগে যোগব্যায়াম করেন। তাঁর তিন মেয়ে। তিন জনই থাকে আমেরিকায়। বিয়ে করে বাড়ি-টাড়ি বানিয়ে সুখে আছে বলা যেতে পারে। বড় চাচী গ্রিনকার্ড না কী যেন পেয়েছেন। বছরের বেশিরভাগ সময় মেয়েদের সঙ্গে থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে আসেন।
বড় চাচা ফিলসফিতে এম.এ। অধ্যাপনা করতেন। বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। ফিলসফি বিষয়টাতেই সম্ভবত কোনো গণ্ডগোল আছে। এই বিষয় নিয়ে বেশিদিন পড়াশোনা করলেই লোকজন খানিকটা নির্বোধ হয়ে যায় বলে আমার ধারণা। বড় চাচা যেমন হয়েছেন। তবে নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা অতি উচ্চ। ভালো খাওয়াদাওয়া তাঁর খুবই পছন্দ। যদিও গত দুমাস ধরে নিরামিষ খাচ্ছেন। কোথায় নাকি পড়েছেন, নিরামিষ খেলে শরীরে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়। এখন সেই চেষ্টা করছেন। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, শরীরে ইলেকট্রিসিটি হলে লাভ কী? বড় চাচা তার উত্তরে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যার অর্থ–এই গাধা বলে কী!
শরীরে ইলেকট্রিসিটি তৈরি করা ছাড়াও সাধু-সন্ন্যাসীর অনুসন্ধানেও তিনি। বেশকিছু সময় ব্যয় করেন।
তিন ভাইয়ের দুনম্বর হচ্ছেন আমার বাবা। রোগা-পটকা বেঁটেখাটো এক জন মানুষ। অসুখ-বিসুখ তাঁর লেগেই আছে। সম্প্রতি রাতে চোখে কম দেখছেন। বড় চাচার চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোেট। যদিও তাঁকে বড় চাচার চেয়ে অনেক বয়স্ক মনে হয়। ব্যাংকে মাঝারি ধরনের এক জন অফিসার কথাবার্তা একবারেই বলেন না। বাড়িতে যে সময়টা থাকেন তার সবটাই কাটান খবরের কাগজ পড়ে। বাড়িতে দুটো খবরের কাগজ রাখা হয়। আমার ধারণা, এই দুটো খবরের কাগজের প্রতিটি ছাপা শব্দ তিনি তিন চারবার করে পড়েন। আমার বাবা সম্পর্কে অতি সম্প্রতি আমি একটি তথ্য আবিষ্কার করেছি। পরে তা বলা যাবে।
এ বাড়ির সবচে সুপুরুষ, সবচে স্মার্ট এবং সবচে সাকসেসফুল মানুষ হচ্ছেন আমার ছোট চাচা। চোখের ডাক্তার। ভিয়েনা থেকে আই সার্জারিতে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। এসেই দুহাতে পয়সা কামাচ্ছেন। চোখ উঠা রোগ ছাড়াও যে বাংলাদেশে চোখের এত রোগ আছে আমার জানা ছিল না। আমাদের এই তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ছোট চাচার টাকায় করা। একতলায় তিনটা ঘর নিয়ে তাঁর চেম্বার। রোগী দেখেন যে ঘরে, সে ঘরে এয়ারকুলার লাগান। ডিসটেম্পার করা নীল দেয়ালের ঠাণ্ডা ঘর। পর্দার রঙ নীল। দেয়ালে দুটি ছবি আছে। দুটির বিষয়বস্তুও নীল। একটায় নীল সমুদ্র, একটায়। নীল আকাশ। এই প্রসঙ্গে ছোট চাচার বক্তব্য হচ্ছে—আমার এখন পিকাসোর মতো রু পিরিয়ড চলছে।