আমি কিছু বললাম না। ভোলাবাবু বললেন, কিছু চিন্তা করছেন নাকি ভাইজান?
জ্বি না।
মানুষ কখন কোথায় থাকবে বলা খুব মুশকিল। আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম কী জন্যে জানেন? বড় সাহেবের কাছ থেকে টাকা ধার করতে। একটা লুঙ্গি কিব। এগারটা টাকা শর্ট পড়ে গেল। ভাবলাম, বড় সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে আসি। এসে দেখি এই ব্যাপার।
কত টাকা শর্ট পড়েছে বললেন?
এগার টাকা।
আমি অবাক হয়ে সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এগার টাকার কথা বলছে কেন? স্বপ্নেও আমি কি ঠিক এই দৃশ্যই দেখি নি? স্বপ্নেও তো কুদ্দুস এ রকম ফতুয়ার মতো একটা পোশাক পরে এসে বলেছিল, ভাইজান, এগারটা টাকা শর্ট পড়ে গেছে। ব্যাপারটা কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়? আর কিছুই কি এর মধ্যে নেই?
ভাইজান, কী ভাবেন?
কিছু ভাবি না। ভাবনের কিছু নাই। এই মানুষটা মরে আপনাদের খুব সুবিধা করে দিয়ে গেল। এখন দেখবেন আর কোন চিন্তা নাই।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
এখন মিলমিশ হয়ে যাবে। কুমিল্লার কাজ শেষ করে ঢাকায় যখন ফিরবেন, দেখবেন সব ঠাণ্ডা। আপনার হোট চাচী ফিরে আসছেন। তাঁর অসুখও আর নাই। মাঝখান থেকে এই বেচারা শেষ।
এইগুলো কি আপনার ভবিষ্যদ্বাণী?
জ্বি।
ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয়?
জ্বি হয়।
ভাইজানের সঙ্গে কি সিগারেট আছে?
আছে।
আমি সিগারেট বের করে দিলাম। ভোলাবাবু সিগারেট রাতে ধরাতে বললেন, মানুষ যখন বলে হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা, তখন খুব মজা লাগে ভাইজান। মনেমনে হাসি আর বলি, তুমি কী করব? তোমার কি করার কোন ক্ষমতা আছে? ফালাফালি কইরা তো লাভ নাই। কী কন ভাইজান?
তা তো ঠিকই।
একটা শ্যামা সঙ্গীত শুনবেন ভাইজান?
না, থাক।
আচ্ছা থাক।
থাক বলেও গুনগুন করে ভোলাবাবু কী যেন গাইতে লাগলেন। আমার ঘুম পেতে লাগল। কুদ্দুসের বাড়ি পৌঁছলাম গভীর রাতে, আধো-ঘুম ও আধো-জাগরণে।
আকাশে চাঁদ। জ্যোত্সা ঢাকা গ্রাম। অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। এক জন বুড়োমানুষ লণ্ঠন হাতে বের হয়ে এলেন এবং অবাক হয়ে বললেন, আপনারা কারা বাবাসগল?
পরপর তিনটি অদ্ভূত চিঠি
রিমির কাছ থেকে পরপর তিনটি অদ্ভূত চিঠি পেলাম।
প্রথম চিঠিটির উপর লেখা—প্ৰথম কবিতা। তার নিচে আট লাইনের এক ইংরেজি কবি। অনেক চেষ্টা করেও সেই কবিতার কোনো অর্থ উদ্ধার করতে। পারলাম না। কবিতার নিচে রিমির নাম লেখা। সে নিজেই কবিতার রচয়িতা কি-না, কে জানে।
দ্বিতীয় চিঠির উপরে লেখা দ্বিতীয় কবিতা। আট লাইনের একটা বাংলা কবিতা। এই কবিতার নিচেও রিমি লেখা। বাংলা বলেই বোধহয় এই কবিতাটির অর্থ বোঝা যায়
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
পাপড়ি হার ছিল শত শত,
বসন্তে সে হত যখন দাতা
ঝরিয়ে দিতো দুচারটে তার পাতা,
আজ বুঝি তার ফল ধরেছে, তাই
হাতে তাহার অধিক কিছু নাই।
হেমন্তে তার সময় হল এবে
পূর্ণ করে আপনাকে সে দেবে।
তৃতীয় চিঠির শিরোনাম হচ্ছে—প্রেসক্রিপশন। সেখানে সত্যি সত্যি কী-সব ওষুধপত্রের নাম লেখা। ক্লোরামফেনিকল, ডোজ-প্ৰতি এক শ সিসি ওজনের জন্যে চার থেকে পাঁচ সিসি। বার ঘন্টা পরপর। এসবের মানে কি? আমি রিমিদের বাসায় টেলিফোন করলাম ফোন ধরলেন খালা। খালা টেলিফোন ধরবেন, এই ভয়ে আমি রিমিকে কখনো টেলিফোন করি না।
তোদের খবর কী-রে?
খবর ভালো।
কী-সব যেন শুনছি—তোর ছোট চাচী না-কি ফিরে এসেছে?
এখনো আসেন নি, তবে এসে যাবেন বলে মনে হচ্ছে।
তোদর কাণ্ডকারখানা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ঐ নার্স মেয়ে এখন কোথায় থাকে?
বাসাতেই থাকে।
বাসাতেই থাকে, আর কেউ কিছু বলে না?
বলার তো কিছু নেই, নিজের অধিকারে সে আছে।
অধিকার! অধিকার আবার কী?
আমি চুপ করে রইলাম। অধিকার ব্যাখ্যা করার যন্ত্রণায় যেতে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘ বক্তৃতায় লাভও কিছু নেই। খালার কানে হাই পাওয়ার আয়না জাতীয় কিছু। আছে। কথা যা বলা হয় ঐ আয়নার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।
হ্যালো টুকু।
জ্বি।
কথা বলছি না কেন?
কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না, তাই বলছি না।
তার মানে?
মানে কিছু নেই। আপনি কি কাইন্ডলি একটু রিমিকে দেবেন?
খালা সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর ভারী করে বললেন, রিমিকে কেন?
একটু দরকার ছিল।
কী দরকার?
আপনাকে বলা গেলে তো শুরুতেই বলতাম। আপনাকে বলা যাবে না।
খালা খানিকক্ষণ কোনো কথা বললেন না। রিমির সঙ্গে আমার কী দরকার। থাকতে পারে, তাই নিয়ে সম্ভবত ভাবতে বসলেন। আমার মনে হল তিনি রিমিকে ডেকে যে দেবেন না সেই অজুহাত তৈরি করতে তাঁর সময় লাগছে। আমি আবার বললাম, রিমিকে একটু ডেকে দেবেন খালা?
ওকে তো ডাকা যাবে না।
ডাকা যাবে না?
না। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ঘুমিয়ে পড়ল?
ইয়ে, ওর খুব মাথা ধরেছে। বাতি-টাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে। বলে দিয়েছে যেন তাকে ডিস্টার্ব না করা হয়। এখন ডাকতে গেলে খুব রাগ করবে।
তাহলে থাক, ডাকার দরকার নেই। একটা জরুরি কথা ছিল। থাক, অন্য সময় বলব।
এই বলেই মনে মনে হাসলাম, কারণ খালার কৌতূহল এখন তুঙ্গে উঠেছে। রিমিকে না ডেকে পারবে না। তাকে ডাকবেন এবং টেলিফোনের কথাবার্তা শোনার প্রাণপণ চেষ্টা করবেন।
খালা বললেন, জরুরি কথাটা আমাকে বল। ও ঘুম থেকে উঠলে বলে দেব।
আপনাকে বলা ঠিক হবে না। ভয়-টয় পাবেন।
ভয় পাব কেন? ব্যাপারটা কী?
আপনাকে বলা যাবে না খালা। আচ্ছা রাখি…
একটু লাইনে থাক, আমি দেখি রিমিকে আনা যায় কি-না।