দরকারের বিষয়টা ভেঙে বলার পরও সন্দেহ যায় না। একজন জিজ্ঞেস করল, ভাইজান, আফনে কী করেন? ছাত্ৰ শোনার পর তার সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কুদ্দুসের ভাই এখানে থাকে কী থাকে না, এটা বলতে অসুবিধা আছে?
থাকে। এইখানেই থাকে।
এখন কোথায়?
ট্রিপে গেছে।
কোথায় গেছে? কখন আসবে?
তা তো ভাইজান বলতে পারি না। গেছে বগুড়া। আরিচাঘাটে আটকা পড়লে সাত দিনের মামলা। আর আটকা না পড়লে ধরেন তিনদিন।
আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে বের হয়ে এলাম। দায়িত্ব পালন করা হয়েছে। এখন আর কেউ বলতে পারবেনা—আমরা খোঁজ-খবর করি নি। কুদ্সের আত্মীয়স্বজন কেউ এলে বলা যাবে যে, চেষ্টার ত্রুটি হয় নি।
বাসায় ফিরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। ছোট চাচীর বাবা গোলাপপ্রেমিক জাজ সাহেব এসেছেন। তাঁকে খাতির করে চা দেয়া হয়েছে। তাঁর সঙ্গে বড় চাচা এবং বড় চাচী আছেন। কথা বলছেন নিচু গলায়। তাদের চোখ-মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বেশ আন্তরিক আলাপ হচ্ছে। এরকম তো হবার কথা না। রহস্যটা কি?
মাকে গিয়ে বললাম, ব্যাপার কিছু জান মা? মিলমিশ হয়ে গেছে না-কি?
মা বললেন, বুঝতে পারছি না। শুনলাম তোর ছোট চাচা নাকী ঐ বাড়িতে টেলিফোন করেছিল।
কখন?
দুপুরে। জাজ সাহেব টেলিফোন পেয়েই এসেছেন।
ছোট চাচা কোথায়?
জানি না।
আমাদের নার্স চাচী? সেও নেই।
দুজনের কেউ নেই।
দুপুরে বাড়িতে কিছু রান্না হয় নি। মরা-বাড়িতে আগুন ধরাতে নেই, এরকম একটা নিয়ম না-কি আছে। হোটেল থেকে আনা খাবার সবাই খেয়েছে। শুধু বড় চাচী খান নি। চোখের সামনে একটা ডেডবডি নিয়ে তিনি সলিড কিছু খেতে পারবেন না। একটা পেপসি এনে খেয়েছেন। সেই পেপসিও বমি করে ফেলে দিয়েছেন।
ডেডবডি রাখা হয়েছে কুদ্সের ঘরে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। একটা বড় প্যাকিং বক্সে বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই বরফ গলে পানি চুইয়ে আসছে। বাড়ির সামনে পাড়ার ছেলেপুলেদের ভিড়। পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর চোখে সানগ্লাস। এই ভদ্রলোক কথা বলছেন বাবার সঙ্গে। পুলিশের সঙ্গে সবাই মোটামুটি মধুর স্বরে কথা বলে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় অতি বুদ্ধিমান লোকের মুখেও বোকা-বোকা একটা ভাব চলে আসে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাবার মধ্যে তা দেখলাম না, বরং মনে হল তিনি ঝগড়ার সুরে কথা বলছেন।
আপনাদের এইসব নিয়ম-কানুনের মানেটা কী দয়া করে বলুন তো? চাক্ষুষ সাক্ষী-প্রমাণ আছে, বোমা ফেটে লোকটা মারা গেছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেটেও এই কথা লিখে দিয়েছেন। এরপর আবার পোস্টমর্টেম কী? এতগুলো মানুষের সাক্ষী-প্রমাণ আপনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না?
জ্বি না। আপনারা মিথ্যা বলতে পারেন।
নাড়িভুঁড়ি কেটে ডাক্তার যা বলবে, সেটাই সত্যি? ঐ ডাক্তার মিথ্যা বলতে পারে না?
অবশ্যই পারেন। মাঝে মাঝে তাঁরাও মিথ্যা বলেন। তবু নিয়ম বলে একটা কথা।
এইসব নিয়ম তুলে দেন না কেন?
নিয়মগুলো ভালো, মানুষ হচ্ছে খারাপ। মানুষ ভালো হলে এইসব নিয়মকানুনের দরকার ছিল না।
শেষ পর্যন্ত পোস্টমর্টেম করাতে হল না। নাসিমুদ্দিন মামা সমস্ত ঝামেলা চুকিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ঢুকে বললেন, আরো তিনশ কুড়ি টাকা দরকার। নিজের পকেট থেকে চলে গেছে। এখন কবর কোথায় হবে সেটা বলেন, এইখানেও টাকার ব্যাপার আছে।
সমস্ত দিন আমার উপর খুব ধকল গিয়েছে। বিছানায় গিয়ে একটু শুয়েছি, ওমি ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। শুধু ঘুম না, ঘুমের সঙ্গে স্বও দেখে ফেললাম। স্বপুটা কুদ্দুসকে নিয়ে। স্বপ্নের মধ্যে কুদ্দুস বেঁচে আছে। আমাকে এসে বলল, ছোট মামা এগারটা টাকা দিতে পারবেন? এগারটা টাকা শর্ট পড়েছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি আমাকে মামা ডাকছ কেন কুদ্দুস? আমাকে না। সব সময়ই ভাই ডাকতে?
কিছু মনে করবেন না ভাইজান, ভুল হয়ে গেছে টাকার অভাবে মাথা ঠিক নেই। কী বলতে কী বলি। শেষ সময়ে এগারটা টাকা শর্ট পড়ল।
আরেকটা কথা কুদ্দুস, তুমি না মারা গেছ। তাহলে কথা বলছ কী করে?
স্বপ্নের এই পর্যায়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি মাথার কাছে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার গাঝাঁকাচ্ছেন। বাবাবললেন,তোর একটু নবীনগর যাওয়া লাগে। কুদ্দুসের বৌছেলেমেয়ে আছে, এদের শেষ দেখা দেখানো দরকার।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, এখন নবীনগর যাব?
হ্যাঁ। তুই একা যাবি না। তোর সঙ্গে ভোলাবাবুও যাবে। ভাগ্য ভালো, হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে। নিজে থেকেই সঙ্গে যেতে রাজি হল।
যাব কিভাবে?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথা বলছিস কেন? এটা আবার কোন দেশি ভদ্রতা? আর ঘুমটাই বা তোর এল কীভাবে? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, বাড়িতে ডেডবডি।
আমি বাবার সঙ্গে একতলায় নেমে এলাম। কুমিল্লা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বেশ আলোব্যবস্থা। কুদ্দুসের ভাই এসেছে। তার বগুড়া যাওয়া হয় নি। আরিচাঘাটে গণ্ডগোল হওয়ায় ফিরে এসেছে। ফিরে এসে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে কোত্থেকে যেন একটা ট্রাক যোগাড় করেছে।
ডেডবডি ট্রাকে তোলা হয়েছে। ভোলাবাবুও ডেডবডির সঙ্গে ট্রাকের পেছনে বসে আছেন। আমাকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। কাছে যেতে বললেন, ড্রাইভারের সঙ্গে বসে কী করবেন? পেছনে চলে আসেন, হাওয়া খেতে খেতে যাব। সিনসিনারি দেখব। আমি পেছনেই উঠলাম। ট্রাক ছাড়ল সন্ধ্যার আগে আগে। ভোলাবাবু বললেন, পেছনে উঠার একটাই অসুবিধা, সিগারেট খেয়ে আরাম পাওয়া যায় না।