এ বাড়িতে কী যে হচ্ছে, তা তিনি পুরোপুরি জানলেন সন্ধ্যার পর পারিবারিক বৈঠকে। তিনি জানলেন যে, এ বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে ছোট চাচী উকিল নোটিস পাঠিয়েছেন। কারণ বাড়িটা তাঁর নামে দলিলপত্র করা। তিনি আরো জানলেন যে, টেলিফোনে ছট চাচাকে নানান ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। ছোট চাচীর বাবা জাজ সাহেব কিছু গুণ্ডাপাণ্ডাও লাগিয়েছেন যারা একদুপুরে ছোট চাচার গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়ে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় দুজন শুটকো মত লোক ছোট চাচার চেম্বারে ঢুকে বলে গেছে, এই যে চোখের ডাক্তার, চোখ দুটো গেলে দিলে কেমন লাগবে, বলেন দেখি? একদিন এসে দুটো চোখ গেলে দিয়ে যাব।
জাজ সাহেবের মতো গোলাপপ্রেমিক লোক এরকম গুণ্ডা লাগাবেন, তা ভাবা যায় না। তবে তিনি যে লাগিয়েছেন তা বোঝা গেল মঙ্গলবার রাত নটার দিকে। পুরো ব্যাপারটা ঘটল আমার চোখের সামনে। আমি বাড়ির সামনের ফুটপাতে সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি, হঠাৎ দেখি রোগা একটা ছেলে মোটর বাইক নিয়ে গেটের কাছে এল। এক পলকের জন্যে থেমে ঝড়ের বেগে বাইক নিয়ে চলে গেল, পর মুহূর্তেই বিকট আওয়াজ। তখনো বুঝতে পারে নি যে, এই মোটর বাইকওয়ালা ছেলেটা একটা বোমা ফাটিয়ে গেছে। এই বোমায় আমাদের কারোর কিছু হল না—ছোট চাচার গাড়ির ড্রাইভার কুদ্দুসের বাঁ পা উড়ে গেল। কুদ্দুস এমন অবস্থায়ও জ্ঞান হারাল না। শীতল গলায় বলল, ভাইজান, আমারে হাসপাতালে নেন। হাসপাতালেও কুদ্সের জ্ঞান বজায় রইল। অথচ বড় চাচী সেই যে বোমার শব্দে জ্ঞান হারালেন তা ফিরে পেলেন পরদিন ভোর ছটায়। জ্ঞান পাবার পর জানতে পারলেন কুদ্দুস মারা গেছে।
আমরা বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম। কুদ্সের আত্মীয়স্বজনের কারোর কোনো ঠিকানা আমরা জানি না। কুদ্স একবার বলেছিল, তার দেশ চাঁদপুর। সে প্রতি দুমাস পর তিন দিনের ছুটিতে চাঁদপুরে যায়, সঙ্গে ছোট ছোট শার্ট-প্যান্ট থাকে। এই শার্টপ্যান্ট কি তার ছেলেদের জন্যে? কত বড় তারা—আমরা তার কিছুই জানি না।
কুদ্দুস যে ঘরে থাকতো, সেখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। এক জন মানুষ কোনো রকম ঠিকানা না রেখে ঠিকানাবিহীন এক দেশের দিকে রওনা হল।
কুদ্দুসের ডেডবডি নিয়ে আমরা মহাযন্ত্রণায় পড়লাম। সাধারণ মৃত্যুতেই অনেক সমস্যা, অপঘাতে মৃত্যু মানে—অতলান্তিক সমুদ্র। পোস্টমর্টেম হবে, পুলিশী তদন্ত হবে, কেইস ফাইল হবে, পত্রিকার লোকজনও নিশ্চয়ই আসবে। এই জাতীয় মৃত্যুগুলো সম্পর্কে পত্রিকাওয়ালাদের আগ্রহ সীমাহীন। হত্যা, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ভেতরকার কথা, ঘাতক বোমা, পুলিশ নীরব।
এই রকম কোনো মৃত্যু ঘটা মানে জলের মতো টাকা যাওয়া। সবাইকে টাকা খাওয়াতে হয়। পান খাবার জন্যে সবাই কিছু-না-কিছু পাবে। এখন কথা হচ্ছে কুদ্সের জন্য এত ঝামেলা আমরা করব, কি করব না। তবে টাকাওয়ালা মানুষের জন্যে কোনো ঝামেলাই ঝামেলা না। আমরা নাসিমুদ্দিন নামে আমাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়কে খবর দিলাম। তিনি অফিস ফেলে তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলেন। মুখভর্তি পান। হাসি হাসি ভাব। যেন এই ঝালেমায় খুব আনন্দ পাচ্ছেন।
এই জাতীয় চরিত্রের সংখ্যা আমাদের সমাজে প্রচুর। এঁরা হচ্ছেন সমস্যা-বিশারদ। বিস্তর লোকজনকে তাঁরা চেনেন। কার কাছে গেলে কোন কাজটা হয়, তা এঁদের নখদর্পণে। পুলিশের লোক, মন্ত্রীর পি. এ.-দের সঙ্গেও তাঁদের মাখামাখি থাকে। চব্বিশ ঘন্টার নোটিসে এরা পাসপোর্ট বের করতে পারেন। কেউ হয়ত বিদেশ থেকে প্রচুর মালামাল নিয়ে আসছে, তাঁকে খবর দিলে তিনি এমন ব্যবস্থা করবেন যে, কাস্টমসের লোকজন ব্যাগ না খুলেই চক দিয়ে ক্রসচিহ্ন দিয়ে দেবে। হাউস বিল্ডিং-এর লোন কী করে পেতে হয় তাও তাঁরা খুব ভালো করে জানেন।
নাসিমুদ্দিন মামা ঘরে পা দিয়েই বললেন, চিন্তার কিছু দেখছি না। আগে চা নিয়ে আস, চা খেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি টেলিফোন ঠিক আছে? গোটাদশেক টেলিফোন করতে হবে।
আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আর ভয় নেই, এবার ব্যবস্থা হবেই। নাসিমুদ্দিন মামা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, হাজার তিনেক টাকার ব্যবস্থা করেন, ছোট নোট। এর আত্মীয়স্বজনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
বাবা বললেন, না। চায়ের দোকানের এক ছেলে বলল, কুমিল্লানবীনগরে বাড়ি। আগে শুনেছিলাম চাঁদপুর।
লোকাল কাউকে খুজে বের করতে হবে। এই লাশ নবীনগরে কে নিয়ে যাবে? দেখি কোনো খোঁজ করতে পারি কি-না। চায়ের দোকান, সিগারেটের দোকান এইসব জায়গায় খোঁজ করতে হবে। আশপাশের লন্ড্রিতে পাত্তা লাগাতে হবে। দেখি কী করা যায়।
নাসিমুদ্দিন মামা অসাধ্য সাধন করলেন। খোঁজ বের করলেন, এসি দাস রোডের এক মেসে কুদ্সের চাচাতো ভাই থাকে। সেও ড্রাইভার। ট্রাক চালায়। ছাই ফেলতে ভাঙাকুলা—আমাকে বলা হল কুদ্দুসের ভাইয়ের সন্ধানে যেতে।
সিনেমাতে ডাকাতদলের গোপন আড়া যে রকম থাকে, সেটা অবিকল সে রকম। পয়সা দিয়ে তাস খেলা হচ্ছে। বিড়ির উৎকট গন্ধে কাছে যাওয়ার উপায় নেই। তারা দুপুরের খাবার শেষ করে তা নিয়ে বসেছে। ময়লা থালাবাসন উঠিয়ে নেওয়া হয় নি। বড় বড় নীল মাছি ভভ করছে। তাস খেলোয়াড়রা আমার দিকে খুবই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাল। কুদ্দুসের ভাইটির কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, কী জন্যে দরকার?