লরেটা বলল, আমার বালিশ লাগবে না।
আমি মেয়েটাকে আমার পাশে শুইয়ে দিলাম। এত রাত হয়েছে তব তার চোখে। ঘুম নেই। সে চোখ বড় বড় করে শুয়ে আছে। এক সময় বলল, আমি আপনাকে কী ডাকব?
টুকু ডাকবে। আমার নাম টুকু।
বড়দের বুঝি নাম ধরে ডাকা যায়?
বড় হলেও আমি তোমার বন্ধু। বন্ধুকে নাম ধরে ডাকা যায়। নিয়ম আছে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, টুকু, তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। ঘুম আসছে না।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। সে নিঃশব্দে কাঁদছে। বাতি নিভিয়ে দিলাম। এই শিশুটির চোখের জল আমি দেখতে চাই না।
পরদিন ভোরে ছোট চাচী জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।
সন্ধ্যাবেলা উকিল নোটিস চলে এল। সেই নোটসে কী লেখা আমরা জানলাম না, কারণ, উকিল নোটিস ছোট চাচা কাউকে পড়তে দিলেন না।
রাতে বড় চাচা আমেরিকায় টেলিফোন করলেন। টেলিফোনে বড় চাচীকে বলা হল তিনি যেন এক্ষুনি চলে আসেন। জানা গেল চাচী আসছেন। বড় চাচা এমন ভঙ্গি করতে লাগলেন যেন চাচী আসামাত্র সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ বড় চাচী কখনো কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি। বরং তাঁর দীর্ঘ জীবনে নানান সমস্যা তৈরি করেছেন। এই যে দিনের পর দিন বাইরে পড়ে আছেন এ-ও কি এক সমস্যা নয়?
বিদেশের জলবায়ুতে মেদ বৃদ্ধির কোনো উপাদান আছে। বড় চাচী যতবার বিদেশ থেকে আসেন ততবারই দশ থেকে বারো কেজি বাড়তি মেদ নিয়ে আসেন।
এবার একেবারে গোলআলু হয়ে ফিরলেন। রং আগের চেয়ে অনেক ফর্সা, মাথার চুল কুচকুচে কালো। চুলের রঙে কলপের একটা অবদান বোঝা যাচ্ছে, তবে গায়ের রঙের রহস্যাটা কি, কে জানে।
আমাকে দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন, আর লোকজন কোথায়? আর কেউ এয়ারপোর্টে আসে নি?
আমি বললাম, না।
বড় চাচী অবাক হয়ে বললেন, সে কি! তোর বড় চাচাও আসে নি?
না।
এর মানেটা কি? এত দিন পর আসছি আর এয়ারপোর্টে কেউ নেই। আমি কি ফেলনা?
ফেলনা হবেন কেন? আপনার লাগেজপত্র কি এই, না আরো আছে?
বড় চাচী লাগেজের খোঁজে গেলেন। তিনি নাকি মিডিয়াম সাইজের একটা সুটকেস না নিয়েই চলে এসেছেন। কাস্টমস-এর লোকজনদের সঙ্গে ছোটখাট একটা ঝগড়া শুরু করলেন। তারা বড় চাচীকে আবার ভেতরে ঢুকতে দেবে না, বড় চাচীও ঢুকবেনই। আমি শুনছি তিনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, কোন আইনে আছে যে, একবার বেরিয়ে পড়লে আবার ঢোকা যাবে না? দেখুন, আমাকে রুলস শেখাবেন না। এসব আমার জানা আছে।
আমি চমৎকৃত হলাম। কারণ বড় চাচী যে সব জিনিস চমৎকার জানেন, তা হচ্ছে কী করে লাউ ফুলের বড়া বানাতে হয়, সাজনা গাছের কচিপাতার তরকারি কী করে রাঁধতে হয়, কৈ মাছের পাতুরিতে পেঁয়াজ কাটা দিতে হয় কি দিতে হয় না। তিনি যে কাস্টমস-এর আইন-কানুনও জানেন, তা জানা ছিল না।
টার্মিনাল থেকে বের হয়ে বললেন, গাড়ি কোথায়? আমি নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম, গাড়ি নেই। চলুন বেবিট্যাক্সি নিয়ে নেই। চাচী থমথমে গলায় বললেন, গাড়িও পাঠাল না। এর মানে কি বল তো? এর মানেটা কি?
বাড়িতে নানা ঝামেলা।
ঝামেলার কথা কি আমি জানি না? ঠিকই জানি। আধঘন্টার জন্যে এলে বাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত? বল তুই, কী হত আধঘণ্টার জন্যে এলে?
আমি তাঁকে খুশি করবার জন্যে একটা বিকল্প ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেললাম। চাচী মুখ কালো করে ট্যাক্সিতে উঠলেন। আমাকে বললেন, তুই ড্ৰাইভারের সঙ্গে গিয়ে বোস। তোর গা দিয়ে সিগারেটের গন্ধ বেরুচ্ছে। অন্য কেউ হলে এ কথায় অপমানিতবোধ করত, আমি করলাম না। বড় চাচী এ ধরনের কথা সব সময় বলেন।
তুই এখন করছিস কী?
কিছু না, ল পড়ছি।
ল একটা পড়ার জিনিস হল? খামাকা এটা পড়ছিস কেন? তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি কোন কালে হল না। দাড়িও তো দেখি ঠিকমতো শেভ হয় নি। খোঁচা খোঁচা বের হয়ে আছে।
আমি মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। চাচী খুব যন্ত্রণা করেন। সারাক্ষণ কথা বলেন। এমন সব কথা যা হজম করা বেশ কঠিন। তাঁর মেয়েরা এবং মেয়ের জামাইরা তাকে কী করে সহ্য করেন কে জানে।
ও টুকু।
জ্বি।
তোর জন্যে একটা বাইনোকুলার পছন্দ করেছিলাম। ষাট ডলার দাম। প্যাকেট করে কাউন্টারে গিয়ে দেখি বাইনোকুলারটা কাচে ফাংগাস। আর কেনা হল না।
বাইনোকুলার দিয়ে আমি কী করব? না কিনে ভালোই করেছেন। ঐ সবের আমার দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন? ক্রিকেট খেলাটেলা হলে দূর থেকে দেখবি। পরের বার আসবার সময় নিয়ে আসব, তখন দেখবি কত চমৎকার।
আচ্ছা নিয়ে আসবেন।
মীরা আর ইরার জন্য দুসেট কসমেটিক কিনেছিলাম, এভন কোম্পানির। তাড়াহুড়ার মধ্যে মেয়ের বাসায় ফেলে এসেছি। এখন এমন খারাপ লাগছে। মেয়েগুলোর জন্যে কখনো কিছু আনা হয় না। আশা করে থাকে।
এসব হচ্ছে তাঁর কথার কথা। আমেরিকা থেকে আসার পর প্রথম কিছুদিন যার সঙ্গেই দেখা হবে, তাকেই তিনি এরকম কিছু বলবেন। তাঁর এই স্বভাব নিয়ে প্রকাশ্যেই হাসাহাসি করা হয়। তিনি তা বুঝতে পারেন না। তাঁর ধারণা, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। বুদ্ধি দিয়ে তিনি সব ম্যানেজ করতে পারেন।
ও টুকু।
জ্বি।
বাড়ির অবস্থা কি বল।
গেলেই দেখবেন।
সে তো দেখবই। বলতে অসুবিধা আছে? তোর ছোট চাচা কি মেয়েটাকে বাড়িতে এনে তুলেছে?
হ্যাঁ।
বলিস কী।
ছোট চাচী অর্থাৎ এক্স ছোট চাচী কোর্টে কেইস করে দিয়েছেন, মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন, সম্মানহানি এইসব কী যেন। ভালো ভালো উকিলও দেয়া হয়েছে। আমাদের অবস্থা কেরোসিন বলতে পারেন। ক্ৰমাগত কোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।