স্যারের কাছে আমার নাম রোল নাম্বার লিখে দিয়ে বাসায় এসে দেখি বিরাট নাটক। ছোট চাচা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। বিয়ে হয়ে গেছে। একটা সুটকেস হাতে সমিতা উঠে এসেছে বাড়িতে। তার সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটি তার আগের পক্ষের স্বামীর। যে স্বামী আট বছর আগে মারা গেছেন।
নাটকের মূল অংশটি হচ্ছে ভেতরের বাড়িতে। বসার ঘরে দুটি সুটকেসের পাশে ছোট মেয়েটি বসে আছে। আমি খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিছুই বোঝা গেল না।
ছোট চাচী ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। দরজা খুলছেন না। মীরাইরা দুজনেই বন্ধ দরজার সামনে কান্নাকাটি করছে এবং বারবার বলছে, দরজা খুলুন চাচী, দরজা খুলুন। প্লিজ, প্লিজ।
দ্বিতীয় মিটিং চলছে ছোট চাচা এবং বড় চাচার মধ্যে। সেখানেও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে ইংরেজিতে।
সমিতা বসে আছে খাবার ঘরের টেবিলে। মা ঠিক তার মুখোমুখি। এই দুজন কোনো কথা বলছেন না। মা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টিতে রাগ বা ঘৃণা খুব নেই, আছে বিস্ময়।
আমি বসার ঘরে বাচ্চা মেয়েটির কাছে চলে এলাম। নরম গলায় বললাম, কেমন আছ খুকি?
সে ঠিক বড়দের মতো আবেগহীন গলায় বলল, ভালো।
নাম কি তোমার?
মিস লরেটা গোমেজ।
মিস?
হ্যাঁ। বিয়ে হয় নি তো, তাই মিস।
বাচ্চা মেয়েটির কথায় চমৎকৃত হলাম। বাচ্চারা বড়দের সহজেই চমকে দিতে পারে। বড়রা তা পারে না। বড়দের কাণ্ডকারখানায় শিশুরা চমকায় না। আমার মনে হল, এই মেয়ে তার মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ এবং এই বাড়িতে উঠে আসার পুরো ব্যাপারটাই বেশ সহজে মেনে নিয়েছে।
খুকি, তুমি কি এই বাড়িতে থাকবে?
তা ছাড়া কোথায় থাকবো?
কোন ক্লাসে পড় তুমি?
ক্লাস থ্রি।
বাহ্, তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না, তুমি থ্রিতে পড়। মনে হয় ওয়ান কিংবা টু।
মিস লরেটা গোমেজ গম্ভীর গলায় বলল, জানেন, আমি কিন্তু সব ক্লাসে ফার্স্ট হই।
চমৎকার।
বিড়ালের বাচ্চার ইংরেজি কি আপনি বলতে পারেন?
মানুষের বাচ্চার ইংরেজিই জানি না, আবার বিড়ালের বাছা! তুমি জান না কি?
জানি। কিটেন। হাতির বাচ্চার ইংরেজি কি তুমি জান?
মেয়েটা অনেকক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে থেকে বলল, হাতির বাচ্চার কোনো ইংরেজি হয় না।
গভীর মমতায় আমার চোখ ছল ছল করতে লাগল। এই বাড়িতে কত-না দুঃসময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে। বড়দের তৈরি করা নাটকে তার অভিনয় করতে হবে। ইচ্ছা না থাকলেও করতে হবে।
মিস লরেটা গোমেজ, আমি তোমার সঙ্গে বসে খানিকক্ষণ গল্প করি?
আপনার ইচ্ছা করলে করতে পারেন।
আমি তার মুখোমুখি বসলাম। এই প্রথম কালো রোগা বড় বড় চোখের মেয়েটি হাসল। তার হাসির একটাই মানে আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলাম।
সে পা নাচাতে নাচাতে বলল, আচ্ছা বলুন তো, দুটো স্যুটকেসের মধ্যে কোনটা আমার?
সবচে বড়টা।
সে চমকে উঠে বলল, ঠিক বলেছেন। কী করে বললেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয় লরেটা, বাসায় এখন ঝগড়া চলতে থাকবে। বড়দের ঝগড়া করার সুযোগ দিয়ে আমরা দুজন চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।
চলুন।
তুমি কি তোমার মাকে বলে যাবে?
না।
সে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল।
বাড়িতে হৈচৈ চলতেই থাকল।
ছোট চাচীর বাবা গোলাপপ্রেমিক জাজ সাহেব রাত নটার দিকে চলে এলেন। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। তিনি বসার ঘরে বসে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে লাগলেন। কোত্থেকে সেই সন্ন্যাসী ব্যাটাও জুটেছে। সে গভীর আগ্রহে এই অগ্নিকাণ্ড দেখছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েও ভদ্রলোক বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না, কারণ, দেখার কেউ নেই। শুধু আমি এবং সন্ন্যাসী বসে, আর কেউ নেই।
সন্ন্যাসী এর মধ্যে এক কাণ্ড করল-জাজ সাহেবকে বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনার কাছে দেয়াশলাই থাকলে একটা কাঠি দিন। কান চুলকাব।
হু আর ইউ?
আমি স্যার কেউ না, সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী।
এইখানে কী চান?
বললাম না, আমি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, কারো কাছে আমার কিছু চাইবার নেই। আপনি স্যার এইভাবে চিৎকার করবেন না। এরকম রাগারাগিতে অনেক সময় হার্ট এ্যাটাক হয়।
শাট আপ।
জ্বি আচ্ছা স্যার। আপনার কাছে তাহলে দেয়াশলাই নেই?
শাট আপ।
অতি উত্তপ্ত আবহাওয়া রাত এগারটার দিকে হঠাৎ করে খানিকটা পড়ে গেল। বড় চাচা এসে জাজ সাহেবকে কী যেন বললেন, তিনি বাড়ি চলে গেলেন। ছোট চাচী ঘরের গরজা খুলে বের হয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মনে হল না খুব আপসেট।
আমার কাছে একমাত্র বাবাকেই অসম্ভব আপসেট মনে হল। তিনি, মনে হল, কান্নাকাটিও করেছেন, তাঁর চোখ লাল। আমাকে এসে বললেন, কেউ তো সারাদিন কিছু খায় নি। টুকু, তুই কোনো হোটেল থেকে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আয়।
এত রাতে কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। পাওয়া গেলেও কেউ কিছু খাবে বলে মনে হয় না। খিদে লাগলে পাউরুটি-বিসকিট আছে, ঐ খেয়ে শুয়ে পড়বে।
আচ্ছা তাহলে থাক।
আমি সিগারেট প্যাকেট খুলে দেখি পাঁচটা সিগারেট। ঠিক করলাম, আজকের এই বিশেষ রাতটা মনে রাখবার জন্য পর পর পাঁচটা সিগারেট খাব। মাথা যখন ঝিমঝিম করতে থাকবে তখন বিছানায় শুয়ে পড়ব।
সবে দুটা সিগারেট শেষ করেছি, ছোট চাচা লরেটাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, এই মেয়েটাকে শোয়াবার জায়গা পাচ্ছি না। তোর কাছে রাখবি?
রাখব।
এক্সট্রা বালিশ আছে তোর ঘরে?