সে রকম কিছু না তো!
বলিস কী?
যা শুনছ সবই গুজব। বাসায় বলতে গেলে কিছুই হয় নি। খুবই শান্ত পরিস্থিতি। এত শান্ত যে মনে হচ্ছে ছোট চাচা সম্পর্কে যা শুনছি, তাও গুজব।
মেজো খালা এমনভাবে তাকালেন যেন বঝতে চেষ্টা করছেন আমি সত্যি বলছি না। মিথ্যা বলছি। আমার মুখ দেখে তা বোঝা বেশ শক্ত। আমি মিথ্যা কথা বলার সময় খুব স্বাভাবিক থাকি। অত্যন্ত সন্দেহপরায়ণ মানুষও দ্বিধায় পড়ে যায়। মেজো খালা যেমন দ্বিধায় পড়ে গেছেন।
যাই খালা।
চাটা কিছু খেয়ে যা।
আজ একটা জরুরি কাজ আছে। অন্যদিন এসে চা খেয়ে যাব।
তোদের বাসায় তাহলে কোনো ঝামেলা নেই।
উহুঁ।
বাসায় ঝামেলা নেই কথাটা এক শ ভাগ মিথ্যা। অসম্ভব ঝামেলা চলছে। ছোট চাচী সত্যি সত্যি ঘুমের ওষুধ খেয়ে কেলেংকারি কাণ্ড করেছে। ছোট চাচীর বাবা রিটায়ার্ড জাজ সাহেব বলেছেন, তিনি দেখে নেবেন। আমার বড় চাচা ঘন ঘন মিটিং করছেন। ছোট চাচাকে আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। বড় চাষীকে আমেরিকায় টেলিফোন করা হয়েছে। শুক্রবারে তাঁর আসার কথা।
ছোট চাচা কদিন ধরেই চেম্বারে যাচ্ছেন না। বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে থাকেন। এই কদিন দাড়ি-গোঁফ না কামানোয় সমস্ত মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কুৎসিত একটা অবস্থা। এদিকে বাবা আবার বিছানায় পড়ে গেছেন। দিনে কুড়িবার করে তাঁকে বাথরুমে যেতে হচ্ছে। কয়েক গ্যালন স্যালাইন ওয়াটার খেয়ে তাঁর কিছু হচ্ছে না।
এতসব ঝামেলার মধ্যে কমলা আবার ছাদে ভূত দেখে দাঁত কপাটি লেগে পড়ে গেল। ভূতটা নাকি শূন্যে হাঁটছিল। কমলাকে দেখেই লম্বা কালো হাত বাড়িয়ে বলল,
এই কমলা, তোকে ছুঁয়ে দিলাম। কমলার এই ভূতের কথা কেউ বিশ্বাস করছেনা, তবে সবাই ভয়ে আধমরা। মীরাইরা সামান্য শব্দেই চেঁচিয়ে উঠছে। মাকে ঘুমুতে হচ্ছে মীরা-ইরার সঙ্গে। অথচ তাঁর খুব ইচ্ছা তিনি অসুস্থ বাবার সঙ্গে থাকেন। তা সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল রাতে আমাকে এসে বললেন, ও টুকু, তুই তোর বাবার সঙ্গে ঘুমুবি?
আমি হেসে ফেললাম।
মা দুঃখিত গলায় বললেন, হাসছিস কেন? হাসির কথা বলেছি?
হুঁ বলেছ।
বাবার সাথে ছেলেরা ঘুমায় না?
দশ বছরের নিচের ছেলেরা হয়ত ঘুমায়। চব্বিশ পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলেরা ঘুমায় না।
ঘুমুলে অসুবিধা কী?
ঘুমুলে দুজনেরই ক্ষতি হয়। দুজনেরই অহংবোধে আঘাত লাগে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুরু হয়। শুরুটা চেইন রিএ্যাকশনের মতো। একবার শুরু হলে অতি দ্রুত এক্সপ্লোসিভ লিমিটে পৌঁছে যায়। তুমি বুঝবে না।
মা চুপ করে গেলেন।
কিছু কঠিন কঠিন শব্দ এদিক-ওদিক করে বললেই মা চুপ করে যান। ক্ষীণ স্বরে মাঝে মাঝে বলেন, কথা বলার সময় তো বড় বড় কথা, এদিকে পরীক্ষায় তো গোল্লা খাস।
আজ সে রকম কিছু বললেন না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল
ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল।
ছোট চাচা এক দুপুরে বাসায় এসে মীরাকে বললেন, মীরা, আমি সমিতাকে আজ বিয়ে করেছি। তুই খবরটা তোর চাচীকে দিয়ে আয়। সমিতা তিনটার দিকে আসবে।
মীরা পানির গ্লাস নিয়ে যাচ্ছিল। অবিকল সিনেমার দৃশ্যের মতো এই কথা শুনে তার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেল।
ছোট চাচা ইংরেজিতে বললেন, আমাদের একটাই মাত্র জীবন। এই এক জীবনে আমাদের অধিকাংশ সাধই অপূর্ণ থাকে। আমি তা হতে দিতে চাই না। যা পাই হাত পেতে নেব। তুই তোর চাচীকে খবরটা দিয়ে আয়। যাবার আগে ভাঙা গ্লাসের টুকরাগুলো ফেলে দিয়ে যা। পা কাটবে।
মীরা তার কিছুই করল না। দৌড়ে দোতলায় উঠে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই কমলা ভাঙা গ্লাসের টুকরায় তার পা কেটে রক্তারক্তি করল।
এইসব খবর আমি অবশ্যি জানলাম অনেক পরে। ঐদিন কী মনে করে যেন ক্লাস করতে গিয়েছিলাম। এ. কে. বদরুদ্দোজা নামের নতুন এক জন স্যার আইনের ভাষ্য বলে খানিকক্ষণ বিজবিজ করে কিছু বলতেই হৈচৈ বেধে গেল। পেছনের এক জন উঁচু গলায় বলল, আইন, গাইন। সারা ক্লাস জুড়ে হাসি। হাসি থামতেই ক্লাসের শেষ প্রান্ত থেকে অন্য আরেকজন বলল, আইন, গাইন, ফে, কাফ, কাফ। নতুন স্যার পুরোপুরি হতভম্ভ। এই অবস্থা তিনি কল্পনাও করেন নি। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ইউ, ইউ, উঠে দাঁড়াও। কী শুরু করেছ?
আমি উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক যে পরিমাণ রেগে আছেন—তাঁকে কিছু বলতে যাওয়া অর্থহীন।
কেন তুমি আইন, গাইন করছ? কেন?
আমার পেছন থেকে এক জন বলল, স্যার, ও মাদ্রাসা থেকে পাস করেছে।
আবার চারদিকে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল। গম্ভীর স্বরে অন্য এক জন খুব দরদ দিয়ে শুরু করল, আইন গাইন ফে কাফ কাফ। আলিফ জবর আ, বেজবর বা।
ক্লাস ডিসমিস হয়ে গেল। নতুন স্যার আমাকে বললেন, তুমি আস আমার সঙ্গে। আমি তাঁর সঙ্গে বের হয়ে এলাম। ক্লাস থেকে বের হওয়ামাত্র তিনি বললেন, তোমাকে পঁচিশ টাকা ফাইন করা হল। আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
চল আমার সঙ্গে প্রিন্সিপ্যালের ঘরে। ইউ র্যাসকেল। কত ধানে কত চাল তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
আমি আবারো বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ঘরে আমাকে ঘন্টাখানিক দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন আমি নিরীহ টাইপ কেউ, না কি কোন ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যখন নিঃসন্দেহ হলেন আমি নিরীহ ধরনের এক জন, তখন বললেন, তোমাকে আমি এক্সপেল করছি। ক্যান্সার সেল আমি রাখব না। আমি আবারো বিনীত গলায় বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।