বলেই সে টেলিফোন খট্ করে রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন। এবারে গলা আগের চেয়েও চড়া-টুকু শোন্ আমাদের বাড়িতে আর আসবি না। তোর মনের মধ্যে পাপ আছে। খবরদার, তুই কিন্তু আসবি না।
আমি ঐ বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। এক মাসের মাথায় রিমির চিঠি এসে উপস্থিত। আবেগে টইটমুর চিঠি।
আজ যে এই বাড়িতে এসেছি সেও চিঠি পেয়ে। তাও এমন চিঠি, যেই পড়বে মাথায় হাত দিয়ে বসবে।
রিমি আমাকে দেখে কোল থেকে বই নামিয়ে বলল, তুই দেখি বাগানে মার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললি।
হ্যাঁ, বললাম।
কী কী কথা হল শুনি।
তেমন কিছু না।
যেমনই হোক কথাগুলো আমি শুনতে চাই।
বললাম তত, ইম্পৰ্টেন্ট কোনো কথা হয় নি। বাড়ি নিয়ে কথা হল। রুমগুলো ছোট ছোট, এইসব।
রিমি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবার সম্পর্কে মা কি তোর সঙ্গে কোনো কথা বলেছেঃ হা কিংবা না বলবি। হয়েছে কোনো কথা?
না।
বাবা মারা গেলেন পনের দিনও হয় নি। আজ হচ্ছে ফোর্টিনথ ডে, অথচ মা বাবার সব স্মৃতি মুছে ফেলেছে। সারাক্ষণ বাড়ি বাড়ি করছে। ঘর সাজাচ্ছে। বাগান করছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি। তাঁকে দেখে যে কেউ বলবে—এক জন সুখি মহিলা। ওজন পর্যন্ত বেড়েছে। পরশু রাতে বাথরুমে গুন গুন করে গান গাইছিল।
কষ্টের একটা ব্যাপার সারাক্ষণ মনে রেখে লাভ নেই। কেউ রাখেও না। তুইও রাখবি না। কিছুদিন পর দেখা যাবে তুইও দুপুরবেলা শিবরামের বই পড়ে খিলখিল করে আসছিল।
টুকু, আমাকে তুই তুই করে বলবি না। তোর মুখে তুই শুনতে খুব খারাপ লাগে।
আচ্ছা বলব না।
বোস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমি বসলাম। রিমি তার গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে কাছে এগিয়ে এল। গলার স্বর নিচু করে বলল, আনন্দে মার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।
আমার তো মনে হয় তোর নিজের মাথাই এলোমেলে।
আমার মাথা আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। আর তা নেই। বাবার টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
ছিনিমিনি খেলছে মানে?
রকিব সাহেব বলে এক ভদ্রলোককে দুলাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। উনি ঐ টাকা দিয়ে ব্যবসা করবেন এবং তার আয় থেকে মাকে মাসে মাসে সাত হাজার টাকা দেবেন। ঐ টাকায় আমাদের সংসার চলবে।
ব্যবস্থা তত ভালেই মনে হচ্ছে।
তোর মাথা মোটা, এই জন্যে তোর কাছে ব্যবসা ভালো বলে মনে হচ্ছে। ঐ লোকটা ধুরন্ধর প্রকৃতির।
বুঝলি কী করে?
আমি বুঝতে পারি। মানুষের চোখের দিকে তাকালেই সেই মানুষটা কেমন আমি বুঝতে পারি। যেমন ধর, তুই-তুই হচ্ছিস বোকা।
শুনে ভালো লাগল।
শুনে তোর ভালো লাগছে। কারণ তুই বোকাই থাকতে চাস। বোকা থাকার মজা আছে, এইটা তুই টের পেয়ে গেছিল।
রকিব সাহেব লোকটা কে?
বাবার বন্ধু। আগেও আসত। তখন ড্ৰয়িং রুমে বসে ভিসিআর দেখত। এখন সরাসরি মার শোবার ঘরে উঁকি দেয়।
উকি দেয়া এবং ঢুকে যাওয়া তো এক না।
এখন উঁকি দিচ্ছে। দুদিন পরে ঢুকবে।
রিমি আবার চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই তো জানি না আমরা এখন সমস্ত আত্মীয়স্বজন থেকে আলাদা। মা আমার সব চাচাদের সঙ্গে ঝগড়া করছেন।
কারণ কি?
মার ধারণা, সব চাচাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের টাকা-পয়সা হাতানো। মা তা হতে দিতে চান না।
তোদের কি অনেক টাকা নাকি?
মনে হচ্ছে তাই। অবশ্যি আমি ঠিক জানি না। বাবার তিনটা ইস্যুরেন্স ছিল। সেখান থেকে টাকা এসেছে। ফিক্সড ডিপোজিট ছিল। ডিফেন্স বন্ড ছিল। সাভারে জমি আছে দুবিঘা। নিউ এয়ারপোর্টের কাছে দশ কাঠা জমি কেনা হয়েছে। মগবাজারে একটা ফ্যাট কেনা আছে। চারতলায় ফ্ল্যাট।
বলিস কী।
বাবা অসৎ লোক ছিলেন তা জানতাম কিন্তু এতটা অসৎ ছিলেন তা জানতাম না। যতই জমিজমা, বিষয়-সম্পত্তির খবর পাচ্ছি ততই অবাক হচ্ছি।
অসৎ মানুষের ছেলেমেয়েদের জীবন মোটামুটি সুখেরই হয়। তাদের টাকাপয়সার অভাব থাকে না। ভোর জীবনটা সুখেই কাটবে।
রিমি ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, শুয়ে থাক, তোর বোধহয় জ্বর বাড়ছে।
রিমি ক্লান্ত গলায় বলল, দিন দিন তোর চেহারা এত খারাপ হচ্ছে কেন?
খারাপ হচ্ছে নাকি?
কেন, আয়নায় নিজেকে দেখিস না? তোকে দেখাচ্ছে বাসের কন্ডাকটরদের মত। আচ্ছা, তুই এখন যা, তোর সঙ্গে কথা বলতে এখন আর ভালো লাগছে না।
মেজো খালার বাগানের কাজ শেষ হয়েছে। তিনি ঝরনার পানিতে হাত ধুচ্ছেন। আমাকে বেরুতে দেখে অপ্রসন্ন গলায় বললেন, কথা হয়েছে রিমির সঙ্গে?
হুঁ।
ও কী বলল?
তেমন কিছু না।
আহ শুনি না। কী বলল? আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে?
না।
আমার শত পুরুষের ভাগ্যি। ও তো আমাকে এখন দুচোখে দেখতে পারে না। এমন সব কথা বলে যে, ইচ্ছে করে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যাই। আমি নাকি তার বাপের সম্পত্তি নয় ছয় করছি। ওর আছে কী যে আমি নয় ছয় করব? একটা দারোয়ান রেখেছি, একটা মালী রেখেছি। অনুচিত হয়েছে? তুই বল।
না। অনুচিত হয় নি।
রিমির ধারণা, দারোয়ানমালী এসব আমাদের দরকার নেই। আমরা দুজন মোটে মেয়েমানুষ, একা একা থাকি। দারোয়ান-মালী ছাড়া চলবে কিভাবে?
তা তো বটেই।
এসব কথা থাক। তোর কাছে তোদর কথা শুনি।
কী শুনতে চান?
তোদের বাড়িতে হচ্ছেটা কী?
কিসের কী হচ্ছে?
ন্যাকা সাজবি না। ভোর ন্যাকা ভাবটা অসহ্য। তোর ছোট চাচা নাকি কোন নার্সকে বিয়ে করে ফেলেছে?
এ রকম অবশ্যি শোনা যাচ্ছে। সত্যি-মিথ্যা জানি না।
আমি তো শুনলাম, ঐ হারামজাদীকে বাড়িতে নিয়ে তুলেছে। তোর ছোট চাচী ঘুমের ওষুধ খেয়ে মর মর।