আমাদের কাজের মেয়েটি একবার ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বিড়ালের তিনটা বাচ্চা মেরে ফেলল। মা-বিড়ালটা পাগলের মতো হয়ে গেল। নালিশ জানাবার ভঙ্গিতে একেকজনের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ছে, ছটফট করছে। মা-বিড়ালের দুঃখ দেখে আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম। কাজের মেয়েটাকে তার নৃশংসতার জন্যে মাসের পুরো বেতন দিয়ে বরখাস্ত করা হল। সে হাসিমুখে তার টিনের সুটকেস নিয়ে মিরপুরে চলে গেল। চব্বিশ ঘন্টা পর দেখা গেল মা-বিড়াল তার সন্তান-শোক ভুলে দিব্যি। খাওয়া-দাওয়া করছে। বিকেলে রোদে শুয়ে আরামে হাই তুলছে। এদিকে মতির মার অভাবে সংসার হয়েছে অচল। ঢাকা শহরে কাজ করতে পারে, এ রকম কাজের মেয়ে বাঘের চোখের মতোই দুর্লভ। কাজেই পরদিন সকালে আমি নিজেই মতির মাকে আরো কুড়ি টাকা বেশি বেতন কবুল করে নিয়ে এলাম। তিনটি বিড়ালছানা-হত্যার জন্য মতির মার কুড়ি টাকা বেতন বেড়ে গেল। মাস চারেকের মধ্যে মা-বিড়ালটা বাচ্চা দিল। নিজের ক্ষমতা জাহির করবার জন্যেই মতির মা ঐ বাচ্চা কটিকেও আগের ভঙ্গিতে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে মারল। আমরা এইবার তাকে আর কিছু বললাম না। আর আশ্চর্য, মা-বিড়ালটাও আগের মতো হৈচে, দৌড়-ঝাঁপ করল না। সে হয়ত ইতিমধ্যে কন্ডিশন্ড হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছে, একেকবার বাচ্চা হবে এবং মতির মা ঝাড়ু দিয়ে সেগুলোকে পিটিয়ে মারবে। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা সে গ্রহণ করেছে শান্ত ভঙ্গিতে।
আমরা মানুষরাও কি তাই করি না? .
মেজো খালার উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় পা দিয়ে এই জাতীয় কিছু। ফিলসফিক চিন্তা মাথায় এল। এই বাড়িটির সঙ্গে আমার মেজো খালুর অনেক দুঃখকষ্ট এবং স্বল্প জড়িয়ে আছে। এই বাড়ির প্রতিটি ইটে তাঁর মমতামাখা। অথচ বেচারা এই বাড়িতে উঠবার দুদিন আগে মরে গেলেন। প্রকৃতির কী ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। অথচ ফরিদা খালাকে দেখে মনে হল প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতাকে তিনি শান্ত ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছেন। হাসি-খুশিতে বাগানে কী যেন একটা চারা লাগাচ্ছেন। আমি বললাম,
আপনাদের নতুন বাড়ি দেখতে এলাম খালা।
খালা আনন্দিত স্বরে বললেন, আয় আয় আয়।
বাড়ি কোথায় খালা, এ তো দেখি রাজপ্রাসাদ। হুলস্থূল কারবার।
আনন্দে খালার মুখ আরো উজ্জ্বল হল। তিনি প্রায় কিশোরীদের গলায় বললেন, বাইরে থেকে বড় দেখায়, আসলে অত বড় না। রুমগুলো ছোট ছোট।
তাই নাকি?
শুধু মাস্টার বেডরুমটা বেশ বড়। অন্যগুলো ছোট।
রুম সব মিলে কটা?
খালা হড়বড় করে রুমের সংখ্যা, বাথরুমের সংখ্যা, স্টোররুমের আয়তনের কথা বলতে লাগলেন। আমি এমন ভঙ্গি করলাম যেন গভীর আগ্রহে শুনছি। শুনে খুবই আনন্দ পাচ্ছি। নিজের আগ্রহটা বোঝাবার জন্যে দুএকটা টুকটাক প্রশ্ন করতে হচ্ছে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়াতে হচ্ছে।
বুঝলি টুকু, স্টোররুমটাকে অনায়াসে একটা ঘর করা যায়। বড় জানালা আছে, সিলিং ফ্যান লাগাবার ব্যবস্থা আছে। ভাবছি ঐটাকে একটা ঘর করব।
কিন্তু আপনার তো একটা স্টোররুম দরকার।
কোনোই দরকার নেই। রান্নাঘরেবিট-ইনকআছে। রাজ্যের জিনিস সেখানে রাখা যায়।
তাহলে তো চমৎকার।
ভালে আর্কিটেক্ট দিয়ে বাড়ি করবার এই হচ্ছে সুবিধা। নৰ্বই হাজার টাকা নিয়েছে আর্কিটেক্ট। তখন সবাই বলেছে, এত টাকা আর্কিটেক্টকে দেয়ার দরকার কী? তারা যাকরবে তা তো জানাই আছে। থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়। আমি নিজেও তাই ভেবেছিলাম। এখন দেখলাম আর্কিটেক্টের দরকার আছে।
তবে যে বললেন রুমগুলো হোট ছোট হয়েছে।
মডার্ন আর্কিটেক্ট রুম ছোট ছোট হয়। বড় রুম দিয়ে তুই কররি কী? ফুটবল খেলার জন্য তো রুম না।
তা তো বটেই।
তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। তোদর বাড়ির কি সব উড়ো খবর পাচ্ছি। সত্য-মিথ্যা তাও জানি না। টেলিফোন করে যে খোঁজ নেব সেই উপায়ও নাই। টেলিফোন কানেকশন এখনো দেয় নি। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে নাকি দেবে। ওদের বিশ্বাস নেই। শেষ পর্যন্ত টাকাই খাওয়াতে হবে। তুই ভেতরে গিয়ে বোস, আমি চারা কটা লাগিয়ে আসছি।
রিমি আছে?
হ্যাঁ, আছে। ওর শরীরটা ভালো না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি, ডাক্তার এখন আসে নি। একা কদিক সামলাব?
রিমি হলুদ রঙের একটা চাদর জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটের উপর বসেছিল। তার কোলের উপর একটা বই। গায়ে চাদর থাকা সত্ত্বেও তার মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। রিমিকে দেখে একটু মন খারাপ হল। যে কোন সুন্দর জিনিসের মধ্যে মন খারাপের একটা উপাদান থাকে। রিমিকে যখনই দেখি তখনি মনে হয় আগের বার যে রকম দেখেছিলাম, তারচে সে আরো সুন্দর হয়েছে। আজ তার শরীর ভালো না। চোখের নিচে কালি পড়েছে। অথচ কি আশ্চর্য, চোখের এই কালিও মানিয়ে গেছে।
রিমি বয়সে আমার মাস তিনেকের বড়। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে খানিকটা জটিলতা আছে। অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা না হলে সে আমাকে চিঠি লিখবে। সেইসব চিঠিকে সরল বাংলায় প্রেমপত্র বলা ছাড়া উপায় নেই। চিঠি পড়লে মনে হবে, আমাকে না দেখার কষ্টে সে মরে গেছে। কিন্তু সেই চিঠি পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলে সে কেন জানি বিরক্ত হয়। আমি একবার তার আবেগপূর্ণ চিঠির জবাবে কিছু গাঢ় কথা লিখে ফেলেছিলাম, সে দারুণ রাগ করেছিল। টেলিফোন করে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইসব তুই কী লিখেছিস? ছিঃ! তুই ছোটভাই, ছোটভাইয়ের মতো থাকবি। এসব কী! তুই কি আমার সঙ্গে প্ৰেম প্ৰেম খেলা খেলতে চাস? রাগে আমার গা-টা জ্বলে যাচ্ছে।