তিনি বললেন, সর্দি, জ্বর-জ্বারি এইসব আমার কখনো হয় না। গোলাপের ঘ্রাণে সম্ভবত রোগপ্রতিরোধী কোনো কিছু আছে। এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। বিজ্ঞানের যে শাখাটি নিয়ে সবচে কম গবেষণা হয়েছে তা হচ্ছে গন্ধ। The science of smell.
গোলাপপ্রেমী বাবার কন্যার অর্থাৎ আমার ছোট চাচীর গোলাপপ্রেম নেই। তিনি ফুল শুকে দেখেন না, কারণ ছোটবেলায় একবার টগর ফুল শুকেছিলেন, গন্ধের সঙ্গে সেই ফুলের ভেতর থেকে আধইঞ্চি লম্বা শুয়োপোকা তাঁর নাকের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।
আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ছোট চাচী বিছানা থেকে উঠে বসলেন। ঘটনাটা তিনি জানেন কি না তাঁকে দেখে তা বুঝতে পারলাম না। তাঁর গায়ে রাত-পোশক। সেই নীল রঙের রাত-পোশাক এতই স্বচ্ছ যে, আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।
ছোট চাচী মিষ্টি গলায় বললেন, কী ব্যাপার টুকু?
কিছু না। আপনার খবর নিতে এলাম। শরীর কেমন?
শরীর ভালোই। আজ বুধবার না? শরীর খারাপ থাকবে কেন?
এই আরেকটা মজার ব্যাপার-সপ্তাহে তিনদিন ছোট চাচীর শরীর ভালো থাকে–বুধবার, শনিবার এবং সোমবার। বাকি চারদিন খুবই খারাপ। সপ্তাহের দিনক্ষণ দেখে শরীর খারাপ হয় কী করে, এটা একটা রহস্য।
যাই চাচী।
তুমি কি শরীরের খোঁজ নিতে এসেছিলে?
জ্বি।
এর আর খোঁজ নেবার কিছু নেই। শরীর আমার সারবে না। Mydaysare numbered.
চিকিৎসা তো হচ্ছে।
এর কোনো চিকিৎসা নেই। যত দিন যাচ্ছে গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্কিনে কোনো অনুভূতি নেই। আমার কথা তোমার বিশ্বাস হয় না, তাই না?
বিশ্বাস হবে না কেন? হয়।
উহুঁ, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা একদিন আমার বুকের স্কিন তোমাকে। দেখাব। নাকি এখনই দেখবে?
না থাক।
এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? ডাক্তারকে যদি দেখাতে পারি, তোমাকে দেখাতে অসুবিধা কি? আমার এত লজ্জা-টজ্জা নেই।
আমি ছোট চাচীর ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। এই চাচীর সঙ্গে বেশি সময় থাকা খুবই বিপজ্জনক। এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ করেছি। একবার সন্ধ্যাবেলা কী কারণে যেন তাঁর ঘরে ঢুকেছি। ছোট চাচী ঘরে নেই। লাগোয়া বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছেন। বাথরুমের দরজা হাট করে খোলা। চাচী বললেন, কে, টুকু নাকি?
হ্যাঁ।
কাইন্ডলি ভোয়ালেটা দিয়ে যাবে? চোখ বন্ধ করে এসো। আমার গায়ে কিন্তু কাপড় নেই।
ঘর থেকে বেরুতেই ছোট চাচার সঙ্গে দেখা। তিনি সম্ভবত ছোট চাচীর ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, ছোট চাচী এখনো কিছু জানেন না।
ঠিক বলছিস তো?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।
গুড। আমি নিজেই তাহলে বলব। তোর কাছে সিগারেট থাকলে আমাকে দিয়ে। যা।
যা করবে বুঝে-সুঝে করবে।
তোর উপদেশের যখন প্রয়োজন বোধ করব তখন জানাব। এই মুহূর্তে আমার প্রয়োজন নেই।
আমি পকেট থেকে সিগারেট বের করছি। ছোট চাচা তা না নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি পড়ার শব্দ হল।
ঘুমুতে যেতে অনেক দেরি হল। বড় চাচা আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি নাকি অসাধারণ বই পেয়েছেন। আমাদের পড়ে শোনাবেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল—বাড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা তিনি কিছুই জানেন না। অবশ্যি না জানার কোনো কারণ নেই। বড় চাচার সেবা-যত্নের জন্যে কমলা নামের যে মেয়েটি আছে সে দুর্দান্ত স্পাই। কোথায় কী হচ্ছে টুক করে তাঁর কানে তুলে দেয়।
মীরা, ইরা এবং আমি তিনজনই এসেছি। মীরা বলল, পরীক্ষার পড়া পড়তে হবে, আজ থাক।বড় চাচা বললেন, আধঘণ্টার বেশি লাগবে না। একটা মাত্র চ্যাপ্টার পড়ব। চ্যাপ্টারটার শিরোনাম হল ইনফিনিটি এন্ড মাইন্ড। অসাধারণ জিনিস। ভাবছি, অনুবাদ করে ফেলব। দশ জনে পড়বে। এতে সমাজে একটা উপকার হবে। কমলা, আমাদের জন্য কফি বানাও তো।
চা এবং কফির সরঞ্জাম বড় চাচার ঘরেই থাকে। কমলা ইলেকট্রিক হিটারে পানি গরম করে ব্রেন্ডারে চমৎকার এক্সপ্রেসো কফি তৈরি করে। বড় চাচার ঘরে মাঝে মাঝে আমি কফির লোভই আসি। এমিতে বোকা মানুষের সঙ্গ আমার বিশেষ ভালো লাগে না। বড় চাচা শুধু বোকা তাই না, বেশ বোকা। তিনি ছাড়া এই তথ্যটি সবাই জানে। কমলাও জানে।
বড় চাচা বললেন, কি, পড়া শুরু করব? ফুল এ্যাটেনশনে শুনবি। পড়ার সময় কাশাকাশি-হাসাহাসি যেন না হয়। কারুর বাথরুমে যাবার ব্যাপার থাকলে এক্ষুনি সেরে আয়।
আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ফিরলাম খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে। বাথরুমে লাল বালতিতে কমলার শাড়ি। সে কি বড় চাচার বাথরুম ব্যবহার করে? তা তো করার কথা না। তাদের বাথরুম আলাদা।
কমলা কফির কাপ এনে হাতে দিল। তার গা থেকে ভুরভুর করে গন্ধ আসছে। গায়ে সেন্ট দিয়েছে বোধহয়।
কমলার বয়স কত? ত্রিশ, না কি আরো কম?
বড় চাচা বললেন, কমলা, তুমিও খাও। সবাইকে বানিয়ে দেবে, নিজে খাবে না এটা তো ভালো কথা না। খাও, কথা না, খাও, তুমি খাও। আই ইনসিস্ট।
মৃত মানুষকে ভুলে যেতে
এক জন মৃত মানুষকে ভুলে যেতে আমাদের কত দিন লাগে?
তীব্র শোক কাটতে লাগে দুদিন, তীব্র শোকের পরের অংশ ভোঁতা শোক কাটতে দশ দিনের মতো লাগে। কোনো রকমে পনের দিন কাটিয়ে দিতে পারলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। তখন আর মৃত মানুষদের কথা মনেই থাকে না। মানুষ অতি উন্নত প্রাণী বলেই শোক পনের দিনের মতো ধরে রাখে। নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীরা চৰ্বিশ ঘন্টার বেশি ধরে রাখতে পারে না।