হরিচরণ!
জে আজ্ঞে।
নতুন হাতি খরিদ করেছি। গৌরীপুরের মহারাজার কাছ থেকে কিনলাম। তিনি কিছুতেই বিক্রি করবেন না। মহারাজা বললেন, আমি কি হাতি বেচাকেনার ব্যবসা করি? তোমার হাতি পছন্দ হয়েছে নিয়ে যাও, কিছু দিতে হবে না। আমি বললাম, ঐটা হবে না। নগদ আট হাজার টাকা উনার খাজাঞ্চির কাছে জমা দিয়ে হাতি নিয়ে চলে এসেছি। ভালো করেছি না?
হরিচরণ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
হাতির নাম রেখেছি বং। পুরুষটার নাম চং, মাদিটার নাম বং। দুইজনে মিলে বংচং। হা হা হা। ভালো করেছি না?
জে আজ্ঞে, ভালো।
শশাংক পাল গলা নামিয়ে বললেন, এখন মূল কথায় আসি। হঠাৎ হাতি কেনার কারণে আমি কিঞ্চিৎ অর্থসংকটে পড়েছি। আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে খাজনা পৌঁছতে হবে। পাঁচ হাজার টাকার সমস্যা। টাকাটা দিতে পারবে?
হরিচরণ মুখ খোলার আগেই শশাংক পাল বললেন, আমি জিনিস বন্ধক রেখে টাকা নিব। বং থাকবে তোমার কাছে বন্ধক। একটা বন্ধকনামা তৈরি করে এনেছি। স্ট্যাম্পে পাকা দলিল। আমি বিশেষ বিপদে পড়েছি। বিপদ থেকে উদ্ধার কর।
হরিচরণ বললেন, আপনি নিজে এসেছেন এই যথেষ্ট। বন্ধকনামা লাগবে না। হাতিও রেখে যেতে হবে না।
শশাংক পাল বললেন, এই কাজ আমি করি না। বন্ধকনামায় আমি দস্তখত করি নাই। টিপসই দিয়েছি। ইদানীং দস্তখত করতে পারি না। হাতকাপা রোগ হয়েছে, শুনেছ বোধহয়। জনসমক্ষে বিরাট লজ্জায় পড়ি বিধায় চাদরের নিচে হাত লুকিয়ে রাখি। এখন বলো টাকাটা কি দিতে পারবে?
হরিচরণ বললেন, এত টাকা আমি সঙ্গে রাখি না। সকালে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসব।
শশাংক পাল আরো কিছুক্ষণ থাকলেন। শরবত খেলেন, পান খেলেন। কিছুক্ষণ গল্প করলেন।
উড়াউড়া শুনতে পেলাম তোমাকে না-কি সমাজচ্যুত করেছে। কথাটা কি সত্যি।
হরিচরণ একবার ভাবলেন বলেন, সমাজচ্যুতির ঘটনা আপনার বাড়িতেই ঘটেছে। আপনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। তারপর মনে হলো এই মানুষকে পুরনো কথা মনে করিয়ে দিয়ে কোনো লাভ নেই। তিনি কিছুই মনে রাখতে পারেন না।
শশাংক পাল বললেন, তুমি না-কি সবার সামনে এক মুসলমান ছেলেকে চাটোচাটি করেছ? গালে চুমা দিয়েছ?
হরিচরণ জবাব দিলেন না।
শশাংক পাল গলা নামিয়ে বললেন, আবার কার কাছে যেন শুনলাম। সেই মেয়ের মা রাইত নিশুথে তোমার ঘরে আসে। তুমি একা থাক, রাইত নিশুথে তোমার ঘরে মেয়েছেলে আসা তো ভালো কথা না। সমাজ থেকে পতিত হবে। হরিচরণ বললেন, পতিত তো আছিই। নতুন করে কী হবো? তা ছাড়া রাইত নিশুথে আমার কাছে কেউ আসে না। ঐ মেয়ে আমারে বাবা ডাকে। আমি তাকে কন্যাসম দেখি।
শশাংক পাল মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, নিজের কন্যা ছাড়া আর কেউ কন্যাসম না। এইটা খেয়াল রাখবা।
আচ্ছা রাখব।
তোমার বাড়িতে তো কোনো লোকজন দেখলাম না। সবাই কি তোমাকে ত্যাগ করেছে?
করেছে। করাই স্বাভাবিক। আমার জাত নাই। সমাজ নাই।
শশাংক পাল বললেন, এইসব নিয়ে চিন্তা করবে না। যার টাকা আছে সে সমাজ কিনবে। আর আমি তো আছি। বামুন পণ্ডিতকে ডেকে ধমক দিয়ে দিব, নিমিষে সে অন্য বিধান দিবে। হা হা হা।
প্ৰচণ্ড শব্দে শশাংক পাল হাসছেন। অথচ এই হাসি প্রাণহীন। মনে হচ্ছে কোনো একটা যন্ত্রের ভেতর থেকে শব্দ আসছে।
হরি!
জে আজ্ঞে।
তোমার এখানে যদি মদ্যপান করি তোমার কি অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নাই।
কলিকাতা থেকে ভালো রাম আনিয়েছিলাম। খাবে একটু?
আমি মদ্যপান করি না।
ভালো। খুব ভালো। মদ্য সর্বগুণনাশিনী। আমার দিকে তাকায়ে দেখ— আমার হয়েছে হাতকাঁপা রোগ। এই সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশ রোগ। কিছু মনে থাকে না।
মদ্যপান ছেড়ে দেন।
কেন ছাড়ব? পৃথিবীতে আমরা এসেছি ভোগের জন্যে। ভোগ নিবৃত্তি না হলে বারবার জন্মাতে হবে। আবার জন্মানোর ইচ্ছা নাই। এই জন্যেই ঠিক করেছি, এই জীবনেই সমস্ত ভোগের নিষ্পত্তি করব।
শশাংক পালের জন্যে মদ্যপানের আয়োজন তার লোকজন অতি দ্রুত করে ফেলল। মেঝেতে কার্পেট বিছানো হলো। তাকিয়া এবং কোলবালিশ নামানো হলো। গ্লাস নামল, বোতল নামল। ধূপদানে অগরু’ পোড়ানো হলো। হুকোয় মেশকাত আম্বুরী তামাক ভরা হলো।
শশাংক পাল তাকিয়ায় হেলান দিয়ে গ্লাস হাতে নিতে নিতে বললেন, বরফ ছাড়া এইসব জিনিস খেয়ে কোনো মজা নাই। বরফকলের সন্ধানে আছি। কলিকাতায় সাহেবপাড়ায় বরফকল পাওয়া যায়। কেরোসিনে চলে। অত্যধিক দাম। তারপরেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিনব। ভালো করেছি না?
কথায় কথায় ‘ভালো করেছি না’ বলা শশাংক পালের মুদ্রাদোষ। প্রশ্নটা তিনি করেন, তবে জবাবের জন্যে অপেক্ষা করেন না। তিনি নিশ্চিত যা করেছেন, ভালোই করেছেন।
হরি!
জে আজ্ঞে।
মহাভারতের যযাতির কথা মনে আছে? তার জীবনটাই ছিল ভোগের। বৃদ্ধ হয়ে গেলে ভোগের তৃষ্ণা মেটে না। তখন সে তিনপুত্রকে ডেকে বলল, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তোমাদের যৌবন আমাকে দিয়ে আমার জরা গ্ৰহণ করবে। আমি আরো ভোগ করতে চাই। কেউ রাজি হয় না। একজন রাজি হলো। সেই একজনের নামটা কি তোমার মনে আছে, হরি?
সৰ্বকনিষ্ঠ পুত্র রাজি হলো। তার নাম পুরু।
ঐটা ছিল গর্ধব। গর্ধবটা রাজি হয়েছে। হা হা হা। মহা গর্ধব। হা হা হা। হাসতে হাসতে শশাংক পালের হেঁচকি উঠে গেল। হেঁচকি থামানোর জন্যে পানি খেতে হলো। মাথায় পানি দিতে হলো। তবু হেঁচকি থামে না। হেঁচাকি দিতে দিতেই তিনি হাতিতে উঠে চলে গেলেন। মাদি হাতি লোহার শিকলে বাধা থাকিল জামগাছের সঙ্গে। হাতির সঙ্গে আছে হাতির সহিস। সহিস মুসলমান, নাম কালু মিয়া। ছোটখাটো মানুষ। অতি বিনয়ী। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না।