জিনের চেয়েও বেশি ভয় ইবলিশ শয়তানকে। মসজিদের আশেপাশেই এদের চলাচল বেশি। মুসল্লিরা নামাজ শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পথে তারা পিছু নেয়। ভয় দেখায়, ক্ষতি করতে চেষ্টা করে।
তিনি কয়েকবার ইবলিশ শয়তানের হাতে পড়েছেন। প্রতিবারই আয়াতুল কুরসি পড়ে উদ্ধার পেয়েছেন। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে গত মাসে। এশার নামাজ শেষ করে হারিকেন হাতে বাড়ি ফিরছেন। ফাকফাঁকা চাঁদের আলো। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠতে যাবেন, হঠাৎ তার চারদিকে ঢ়িল পড়তে লাগল। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার ডানদিকে বিশাল বিশাল শিমুল গাছ। বাতাস নেই কিছু নেই, হঠাৎ শুধু একটা শিমুল গাছের ডাল নড়তে লাগল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে একমনে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলেন। আয়াতুল কুরসি একবার শেষ করেন, দু’হাতে শব্দ করে তালি দেন। আবার পড়েন। আবার তালি দেন। আয়াতুল কুরাসির মরতবা হলো, এই দোয়া পড়ে হাততালি দিলে যতদূর হাততালির শব্দ যায় ততদূর পর্যন্ত খারাপ জিন থাকতে পারে না। আয়াতুল কুরাসির এত বড় ফজিলতের কারণ, এই আয়াতে আল্লাহপাকের এমন সব গুণের বর্ণনা আছে যা মানুষের বোধের অগম্য।
তিনবার আয়াতুল কুরসি পাঠ করে মাওলানা চোখ মেললেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। শিমুল গাছের পাতা নড়ছে না। কটু একটা গন্ধ চারদিকে ছড়ানো। নাক জ্বালা করে এমন গন্ধ।
মাগরেবের নামাজ থেকে এশার নামাজের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান অল্প। ঘণ্টাখানিক। এই এক ঘণ্টার জন্যে বাড়ি যাওয়া অর্থহীন। মাওলানা মসজিদেই থাকেন। তার ভয় ভয় লাগে। বনের মাঝখানে মসজিদ। সন্ধ্যার পর থেকে বনের ভেতর নানান ধরনের শব্দ উঠে। কোনোটা পাখির শব্দ, কোনোটা জন্তু জানোয়ারের, আবার কিছু কিছু শব্দ আছে সম্পূর্ণ অন্যরকম। হুম হুম করে এক ধরনের শব্দ মাঝে মাঝে আসে। এই শব্দের সঙ্গে কোনো শব্দের মিল নেই। শব্দ শুনলেই শরীর ঠাণ্ড হয়ে আসে। ভয় কাটানোর জন্যে মাওলানা কোরান পাঠ করেন। তিনি ইদানীং শুরু করেছেন কোরান মজিদ মুখস্থ করা। একটা বয়সের পর মুখস্থশক্তি কমে যায়। একই জিনিস বারবার পড়ার পরেও মনে থাকে না। এই সমস্যা তার হচ্ছে। তিনি হাল ছাড়ছেন না। কিছুই বলা যায় না, আল্লাহপাক অনুগ্রহ করতেও পারেন। দেখা যাবে তিনি কোরানে হাফেজ হয়েছেন। সহজ ব্যাপার না। আল্লাহর কথা শরীরে ধারণ করা বিরাট বিষয়। সাধারণ মানুষের শরীর কবর দেয়ার পর পাঁচে গলে যায়। কোরানে হাফেজের শরীর পঁচে না।
মাওলানা এশার নামাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে হাতির গলার ঘণ্টার আওয়াজ পেলেন। সোনাদিয়ার জমিদার শশাংক পালের হাতির গলার রূপার ঘণ্টা। অতি মধুর আওয়াজ। তিনি শুনেছেন সোনাদিয়ার জমিদার আরেকট। হাতি কিনেছেন। মাদি হাতি। এখন তিনি দুই হাতি পাশাপাশি নিয়ে চলেন। মাদি হাতিটা থাকে সামনে, পুরুষটা পিছনে। এরা যখন থেমে থাকে তখন নাকি পুরুষ এবং মেয়ে হাতি শুড় জড়ােজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্চয়ই খুব মধুর দৃশ্য। তিনি এখনো দেখেননি। একবার সোনাদিয়ায় যাবেন। দেখে আসবেন।
হাতি নিয়ে কোরান মজিদে একটা সূরা আছে। সূরা ফিল। মাওলানা মনে মনে সূরা আবৃত্তি করে তার বঙ্গানুবাদ করলেন। তাঁর ভালো লাগল।
আলাম তারা কাইফা ফা’আ’লা রাব্বুকা বিআছহবিল ফীল।
হস্তিবাহিনীর সাথে তোমার প্রভু কীরূপ আচরণ করলেন তাহা কি তুমি লক্ষ কর নাই?
আলাম। ইয়াজআ’ল কাইদাহুম ফ্ৰী-তাদলীল। তিনি কি তাদের চক্রান্ত ব্যৰ্থ করেন নাই?
জঙ্গলের পথ ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠেই মাওলানা শশাংক পালের দেখা পেলেন। হাতির পিঠে। শশাংক পাল বসে আছেন। হাতির গায়ের রঙ অন্ধকারে মিশে গেছে। মাওলানা ইদারিসের মনে হলো, জমিদার শশাংক পাল শূন্যের উপর বসে আছেন।
মাওলানা ইদারিস বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আদাব। বিধমীকে আসসালামু আলায়কুম বলা নিষেধ। তাদের বেলায় আদাৰ। আদাব শব্দের অর্থ আছে কিনা। তিনি জানেন না।
শশাংক পাল বললেন, কে?
মাওলানা বললেন, জনাব আমার নাম ইদারিস। আমি জুম্মাঘরের ইমাম।
আমার অঞ্চলে গরু কাটা নিষেধ এটা জানো তো?
জি জনাব জানি।
নিষেধ জেনেও অনেকে গরু কাটে। গভীর জঙ্গলের ভেতর এই কাজ করে মাংস ভাগাভাগি করে। এরকম সংবাদ যদি পাও আমাকে জানাবে। আমি ব্যবস্থা নিব। ভালো কথা, হরিচরণ মুসলমান হয়েছে এরকম একটা খবর পেয়েছি। খবরটা কি সত্য?
সত্য না, জনাব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। পথ ছাড়, আমি যাব।
মাওলানা পথ ছেড়ে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আরো দূরে সরে গেলেন।
শশাংক পাল হাতি নিয়ে হরিচরণের বাড়িতে এসেছেন। হাতি দুটাই সঙ্গে এনেছেন। শশাংক পালের সঙ্গে তাঁর এস্টেটের দুই ম্যানেজার এসেছেন। একজন ইকোবরাদার এসেছে। পান বান্দেস একজন এসেছে। তার কাজ নানান মসলা দিয়ে পান বানানো। শশাংক পালের তামাক খাওয়ার অভ্যাস আছে। অন্যের ইকোয় তিনি তামাক খান না।
শশাংক পালের বয়স চল্লিশ। শরীরের উপর নানান অত্যাচারের কারণে বয়স অনেক বেশি দেখায়। চেহারায় বালকভোব আছে, তবে চোখ জ্যোতিহীন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হাতকাপা রোগ হয়েছে। গাছের পাতা কাপার মতো হাতের আঙুল প্রায়ই থারথার করে কাপে। শশাংক পাল এই কারণেই শীতগ্ৰীষ্ম সবসময় মখমলের চাদরে শরীর ঢেকে রাখেন।
হরিচরণ জমিদার বাবুকে অতি যত্নে বৈঠকখানায় বসিয়েছেন। তাকে তামাক দেয়া হয়েছে। একজন পাখাবরদার পেছনে দাঁড়িয়ে বাতাস করছে। এত বড় জমিদার হঠাৎ তার বাড়িতে কেন এই কারণ হরিচরণ ধরতে পারছেন না। একটা অনুমান তিনি অবশ্যি করছেন— ব্রিটিশরাজকে খাজনা দেবার তারিখ এসে গেছে। শশাংক পাল হয়তো খাজনার পুরো টাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। নি। খাজনা জমা দেবার সময়ই শুধু জমিদাররা ধনবানদের খাতির করেন।